Home সাহিত্য ‘ফ্রেস্কো’ বা দেয়ালচিত্র আসলে কি?

‘ফ্রেস্কো’ বা দেয়ালচিত্র আসলে কি?

সুপ্রভা জুঁই 
৩৫৬ views

দেয়ালচিত্র মূলত চর্চিত হতো প্রাচীন মিসর, গ্রিস, রোম এবং রেনেসাঁর সময় ইতালিতে। দেয়ালচিত্রের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাঝে ‘ফ্রেস্কো’ ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম, যেখানে রঞ্জক পদার্থকে (pigment) মেশানো হয় চুনের মণ্ডে। মিশ্রণটি হতো মূলত ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড বা সোজা কথায় চুনের পানি। তারপর এটা ব্যবহারোপযোগী হয়ে যায় চুনে ভেজা কিংবা শুষ্ক দেয়ালে আঁকার জন্য।

ভেজা দেয়ালে আঁকলে তাকে বলা হয় ‘বুওন ফ্রেস্কো’ (buon fresco )। বুওন হলো ইতালিয়ান শব্দ। যার অর্থ ‘ভালো’ বা ‘যথার্থ’। আবার যদি শুষ্ক দেয়ালে এই শিল্পকর্মটি করা হয় তখন তাকে বলে ‘ফ্রেস্কো সেক্কো’ (fresco secco)। সেক্কো শব্দটিও ইতালিয়ান, যার অর্থ ‘শুষ্ক’।

বুওন ফ্রেস্কোর ক্ষেত্রে আর্দ্র প্লাস্টারের দেয়াল রঞ্জক পদার্থকে শুষে নেয়। যার ফলস্বরূপ চিত্রকর্মটি সম্পূর্ণরূপে দেয়ালের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। যদিও এই প্রক্রিয়ায় শিল্পীকে বেশ দ্রুততার সাথে কাজ করতে হয় যাতে প্লাস্টার শুকিয়ে না যায়। বুওন ফ্রেস্কোর সুবিধা হলো যে এটা দীর্ঘস্থায়ী এবং ভীষণ টেকসই দেয়ালচিত্র।

অন্যদিকে ফ্রেস্কো সেক্কোর সাথে ডিমের কুসুম, তেল অথবা মোম মেশানো হয় এবং শিল্পীর কামনা অনুযায়ী দৃশ্যত ভিন্ন ভিন্ন স্থানে এর প্রয়োগ করা হয়। যে কারণে একজন শিল্পী নিজ অসাধারণত্বের সাথে কোনো বস্তুর খুঁটিনাটি বিষয় পর্যন্ত ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন দেয়ালচিত্রে। এই প্রক্রিয়াটির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এই যে, দেয়ালের প্লাস্টার থেকে আর্দ্রতা ধীরে ধীরে সমগ্র চিত্রকর্মে ছড়িয়ে পড়ে এবং সময়ের সাথে সেগুলো দেয়াল থেকে খসে পড়ে। ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটেছিল মিলানের বিখ্যাত ফ্রেস্কো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ‘দ্য লাস্ট সাপার’ (The Last Supper), (Fig – 1) এর ক্ষেত্রে। খসে পড়ার হার এতটাই ছিল যে শিল্পকর্মটি প্রায় হারাতে বসেছিল। যদিও এখন সেটাকে যত্নের সাথে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

 

6 copy

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ‘দ্য লাস্ট সাপার’ (Fig – 1)

 

আঠারো শতকে ইতালি পম্পেই ও হারকিউলেনিয়াম শহরের কাছাকাছি বেশকিছু দেয়ালচিত্র উদ্ধার করা হয়েছিল, যেগুলো ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্নুৎপাতের ফলে জমা হওয়া কয়লার নিচে সমাধিস্থ ছিল। ১৭৫৫-১৭৫৭ এর মাঝে ‘still life painting’ এর একটা বিশাল সংগ্রহ মাটির তলদেশ থেকে উন্মুক্ত করা হয়েছিল। যেটা গোটা ফ্রান্সে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ‘still life painting’ তাদের প্রধান বাহকে রূপান্তরিত হয়। ‘Still Life with Eggs and Thrushes, Villa of Julia Felix, Pompei  before CE79’ (Figure –  2) ফ্রেস্কোটি নির্দিষ্টভাবে লক্ষণীয়, বিশেষ করে এর ডিমের থালার বাস্তবধর্মী ভাবের জন্য। যেটা দেখলে মনে হয় যেন ছবির জগৎ থেকে সে আমাদের জগতে আসতে চাইছে। চিত্রকর্মের প্রতিটি বস্তুকে তাদের নিজস্ব পরিমাপ অনুযায়ী আঁকার জন্য এই অনুভূতিটা আরও জোরালো হয়ে প্রকাশ পায়, শিল্পীর বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাভাবনার এক স্বচ্ছ প্রতিফলন।

 

5 copy 1

Still Life with Eggs and Thrushes, Villa of Julia Felix, Pompei before CE79
Fresco 35 X 48in. National Museum, Naples. . (Figure – 2)

 

দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকা ফ্রেস্কোর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো রোমান সময়ে ‘Villa of Livia’-তে খুঁজে পাওয়া বিশাল দেয়াল জুড়ে আঁকা এক বাগিচার ছবি। ভিলাটি ছিল প্রিমা পরতার (Prima Porta) নবাব অগাস্টাসের স্ত্রীর (Figure – 3)। আজকালকার সরাইখানার মতো বিশাল পর্বতমালা, নদীনালার সমারোহ, পড়ন্ত বিকেলের মৃদু আলো নিয়ে আঁকা ছবিগুলোর মতো এটি নয়। ছবিটিকে বিশেষভাবে চিন্তা করা হয়েছিল এক ধরনের ‘উন্মক্ততা’ তৈরি করার জন্য। ঠিক যেন একটা আবদ্ধ ঘর থেকে বের হওয়ার দরজার মতো। যেটা দেখলে মনে হয় যেন গ্রীষ্মের নিরুত্তাপ একটা সন্ধ্যার আলো আর মৃদুমন্দ বাতাসকে ধার করে এনে রাখা হয়েছে। শিল্পী তখন এক মায়াময় জগতের স্রষ্টা। একদম সত্যিকারের গ্রীষ্মের পড়ন্ত সন্ধ্যার মতো, যেটা শিল্পগুণে এবং আবহাওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবসম্মত।

 

4 copy 2

Garden, Villa of Livia, Prima Porta, near Rome, Late 1st century BCE
Fresco, H10ft, Museo delle Terme, Rome. (Figure – 3)

 

রেনেসাঁর শুরুতে ১৪ শতকের প্রাক্কাল থেকে ১৭ শতকের শেষ পর্যন্ত এই বাস্তবধর্মী ফ্রেস্কো শিল্পকর্মটি একটানা রাজত্ব করে গেছে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন ছিল যেন খোদ দেয়ালগুলোরই একটা আহ্বান ছিল, একটা চাহিদা ছিল নিজেদেরকে সৃষ্টিশীল উপায়ে বাস্তব সত্তার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য। ফ্রেস্কোর আরেকটি বিশাল সংগ্রহ পাওয়া যায় রেনেসাঁর শুরুর দিকে গিওত্তোর (Giotto) আঁকা ইতালির পাদুনা (Paduna) এলাকার এরিনা চ্যাপেলে (Arina Chapel)। এই চিত্রকর্মে বাস্তবধর্মী প্রবণতাটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

 

3 copy 2

Giotto, Lamentation, c. 1305
Fresco approx. 70 X 75in. Arena Chapel, Paduna, Italy (Fig. – 4)

 

খুব সম্ভবত এরিনা চ্যাপেলটি গিওত্তোরই পরিকল্পনা অনুযায়ী নকশা করা হয়েছিল। বিশেষ করে ফ্রেস্কো ছবিতে ভরপুর একটা ঘর যেখানে ৩৮টি ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যে তুলে ধরা হয়েছে ‘Lives of the Virgin and the Christ’ এর কাহিনী। Lamentation (শোকগাথা), (Fig. – 4) ছবিটাতে দেখা যায় গুটিসুটি মেরে পেছন ফিরে থাকা দুজন যেন আমাদের জগতে প্রবেশ করতে চাচ্ছে ঠিক ‘Bowl of Eggs’ ফ্রেস্কোটির মতো। এই শিল্পকর্মটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো- দৃশ্যে দেখানো হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলোর সাথে সাধারণ মানুষের সংযোগ তৈরি করা। ছবিটির বামদিকের বেশিরভাগ মানুষকে দেখা যায় যিশুর মাথাকে পরম আদরের সাথে ঠায় দিয়েছেন নিজ কোলে। যেন সেটা তাদের নিজেদের শরীরেরই একটা অংশ। এই চিত্রকর্মটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এর ফোকাল পয়েন্টের (focal point) অবস্থান। পুরো কম্পোজিশনের (composition) নিচে বামদিকে যিশুর মুখখানি হলো সেই বিশেষ জায়গা। ভূমির সাথে শৈলশিরার কৌণিক অবস্থানের কারণে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। দূর আকাশের দেবদূতদের দেখলে মনে হবে তারা যিশুর দিকে নেমে আসছেন। ডানদিকে থাকা বেশ লম্বা একজনকে দেখা যায় হাত দুটো প্রসারিত করে তীব্র শোকের ভঙ্গিমায় সামান্য ঝুঁকে রয়েছেন, যেটা হলো তাদের অধোগামী উত্তরণের একটি অনুকরণ মাত্র।

 

2 copy 2

Fra Andrea Pozzo, The Glorification of Saint Ignatius, 1691-1694. Ceiling Fresco. Nave of Sant’ Ignazio, Rome. (Fig. – 5)

 

১৭ শতকের শেষের দিকে ঘরের ছাদে আঁকিয়ে ফ্রেস্কো শিল্পীরা শিল্পক্ষেত্রের শীর্ষ স্থানে চলে আসেন। রোমের সেইন্ট ইগ্নাজিওর জন্য আঁকা ফ্রা আন্দ্রেয়া পোজ্জোর (Fra Andrea Pozzo) ‘The Glorification of  St. Ignatius’ (Fig. – 5) ফ্রেস্কোটি তার মাঝে অন্যতম। এই গির্জার মূল অংশে অর্থাৎ একেবারে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে চোখ মেলে তাকালে এক জাদুকরি দৃশ্যের আবির্ভাব ঘটে। ছাদহীন ঘরটাকে দেখলে মনে হবে মাথার ঠিক উপরেই স্বর্গ যেন তার মোড়ক খুলে বসেছে। চিত্রানুপাতের এক বিশেষজ্ঞ একদা পোজ্জো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, পোজ্জো অনুধাবন করতে পারতেন যে ধনুকাকৃতির কোনো ছাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জানালার উচ্চতার আরও একতলা উপরে যদি আঁকা হয় তখন সেই স্থাপনাকে একটি চিত্রকর্ম পর্যন্ত বর্ধিত করা যায়। সেইন্ট ইগ্নেটিয়াস হলেন Jesuit Order–এর স্থাপক। এই ছবিতে দেখানো হয়েছে যে তিনি মেঘের মধ্য দিয়ে অপেক্ষারত যিশুর দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। ভয়ানক মানবমূর্তিগুলোকে দেখা যায় যতই তারা ছাদের মাঝখানে ছলে আসছে ক্রমান্বয়ে ততই আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে। অবাক করার মতো দারুণ বাস্তবধর্মী একটা প্রচেষ্টা।

 

1 copy 2

Jose Diego Maria Rivera, Sugar Cane, 1931.
Fresco 57 X 94 in. Philadelphia Museum of Art. Gift of Mr. and Mrs. Herbert Cameron Morris. (Fig. – 6)

 

১৯২০ এর দিকে মেক্সিকোতে ফ্রেস্কো বা দেয়ালচিতের পুনরভ্যুদয় হয়, যখন মেক্সিকোর নতুন বিপ্লবী সরকার সর্বসাধারণের জন্য সিদ্ধান্ত নিলো দেয়াল সদৃশ একটা কর্মকাণ্ডের, যাতে করে জনসাধারণের বিপ্লবী মনকে লালিত ও উৎসাহিত করা হয়। দিয়েগো রিভেরার (Diego Rivera) আঁকা ‘Sugar Cane’ (Fig – 6) হলো আটটি সুবহনীয় দেয়াল কাজের মাঝে একটি। ১৯৩১ এর দিকে যেগুলোকে বিশেষভাবে আঁকা হয়েছিল আধুনিক শিল্প জাদুঘরে এক প্রদর্শনীর জন্য। মেক্সিকোর Cuernavaca তে Cortez প্রাসাদের অবিকল অনুরূপ ছিল এটি। ছবিটি একদিকে যেমন বর্ণনা করে শ্রমিক শ্রেণির  সাথে জমিদারদের বৈষম্য তেমনি অন্যদিকে প্রকাশ পায় নিগৃহীত শ্রমিকদের কৌলীন্য।

  • A World of Art- 2nd Edition by Henry M. Sayre, Chapter-11 এর Fresco অংশ থেকে অনুবাদিত।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ