টোকিও, জাপানের রাজধানী এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম একটি শহর। প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই দেশ। তাদের রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি। টোকিও আধুনিকতার ক্ষেত্রে অগ্রগামী, যেমন বুলেট ট্রেনের সূচনা এবং প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক উদ্ভাবন তাদেরই করা। এই বিশাল জনসংখ্যা ও উন্নত অবকাঠামো সমন্বিত একটি মেগাসিটি হিসেবে টোকিও বিশ্ব মানচিত্রে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
তবে দৃঢ় বাহ্যিক রূপের নিচে টোকিও এমন একটি মহানগরী যা সর্বদা বিপদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকে। এর ভৌগোলিক অবস্থান শহরটিকে বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের ‘ফায়ার রিং’-এর উপরে থাকা টোকিও শহরটি চারটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ফলে এটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। জাপানে রয়েছে ১১১টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, যা সার্বক্ষণিক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া প্রশান্ত মহাসাগর থেকে টাইফুন, সুনামির ভয়ও রয়েছে।

টোকিও রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট ২০২২ সালের ডিসেম্বরে টোকিও মেট্রোপলিটন সরকার প্রকাশ করেছে। ছবি: হাউজিং জাপান
টোকিও শহরটি একটি বিস্তৃত সমতল ভূমিতে অবস্থিত। ৪০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য আদর্শ বসবাসের স্থান এই শহর। ইতিহাসে একাধিকবার নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে টোকিও ধ্বংস হয়েছে। তবে জাপানের প্রকৌশলীরা আশ্চর্যজনক সৃজনশীলতার মাধ্যমে শহরটিকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এখন জলবায়ু পরিবর্তন এবং শহুরে ঘনত্বের কারণে এই ঝুঁকিগুলি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতের এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে জাপান হাতে নিয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অভিনব প্রকল্প— ‘টোকিও রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট’।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে টোকিও মেট্রোপলিটন সরকার এই প্রকল্পটির কথা জানান। এই উদ্যোগ শহরটিকে বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ১৮ বছরব্যাপী বাস্তবায়িত এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পটি ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম নাগরিক প্রতিরক্ষা প্রকল্প।
প্রকল্পটির আওতায় আছে সমুদ্রের নিচে ক্যাবল শক্তিশালীকরণ থেকে শুরু করে বন্যার পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বিশাল সুড়ঙ্গ নির্মাণ। শহরের রাস্তাঘাট, নদী ও পার্কগুলো পুনর্নির্মাণ করা, সাইক্লিং রুট তৈরি করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নানা পরিকল্পনাও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া শহরের অবকাঠামোকে আরও মজবুত করার জন্য শক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্গঠিত হচ্ছে।
ফুজি পর্বত, যা একইসাথে জাতীয় গৌরবের প্রতীক এবং টোকিওর অস্থিরতার স্মারক। তাই প্রকল্পে এটি নিয়েও ভাবা হয়েছে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের জন্য প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হচ্ছে, যাতে শহরের বাসিন্দারা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও টাইফুনের কারণে টোকিও আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য শহরটি ইতিমধ্যেই বিপুল পরিমাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৯২ সালে টোকিও বন্যা মোকাবিলায় শুরু করেছিল G-Cans নামে একটি ভূগর্ভস্থ ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, যা এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই সিস্টেমে নতুন সুড়ঙ্গ ও চ্যানেল নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা যায়।

জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য শহরটি ইতিমধ্যেই বিপুল পরিমাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ছবি: বিবিসি
জলবায়ু বিপর্যয় ও ভূমিকম্প মোকাবিলায় অবকাঠামো ও প্রকৌশল বিস্ময়ের পাশাপাশি শহরটি ফায়ার রেজিস্ট্যান্ট বিল্ডিং, ভূমিকম্প প্রতিরোধক সেতু এবং আধুনিক শক্তি সঞ্চালন ব্যবস্থা তৈরি করছে। বিশেষভাবে মোরি জেপি টাওয়ার এবং ইটাই ব্রিজের ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রশংসনীয়।
টোকিওর ইতিহাস দেখিয়েছে যে তারা প্রতিটি বিপর্যয়ের পর আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই প্রকল্পটি শুধুমাত্র ভবিষ্যতের জন্য নয়, এটি টোকিওর মানুষ, ব্যবসা এবং শহরের বৈশ্বিক অবস্থান রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।