পুরান ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট জন্ম নেওয়া ডানপিটে ‘দুলু’র কাজ ছিল যেকোনো আয়োজন পণ্ড করা। মাত্র বিশ টাকা হাতে দিলেই ডিম ছুড়ে মারতেন স্টেজে। আর ‘কে মেরেছে, কে মেরেছে’ খুঁজতে খুঁজতে দুলু পগারপার। সেই দুলুই আবার অস্ত্র হাতের মুক্তিযোদ্ধা।
ভাবা যায় এমন পরিবর্তন? যায় যদি, দেশের প্রয়োজনে, যেকোনো কাজে-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার তারুণ্যের যে স্রোত, সেই স্রোতের নাবিক দুলু ওরফে আকবর হোসেন পাঠান দুলু ওরফে নায়ক ফারুকের নাম থাকে সেই তালিকায়।
শাহরুখ খানের সিনেমার পর থেকে বলিউডে কিং খানকে কেউ কেউ ‘পাঠান’ বলে ডাকলেও বাংলাদেশের ‘পাঠান সাহেব’ এই ফারুক। যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল সংগ্রাম। তাই তো কখনও পর্দার বিপ্লবী আবার কখনও গ্রামের লাঠিয়াল।
‘সুজন মাঝি’ সিনেমায় ‘সাত সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা’ নিয়ে তিনি সুজন হলেও লাঠি হাতে তাড়ার দৃশ্য সহজে ভোলার নয়। গ্রাম বাংলার চিরচেনা রূপ ফুটে উঠতো ফারুকের বিভিন্ন চরিত্রে। যে বিপ্লব তিনি করে গেছেন বাস্তব জীবনেও। অস্ত্র হাতে করেছেন মুক্তিযুদ্ধ।
তবে তার বিপ্লবী চরিত্র ১৯৭১ সালের আগেই জেগেছিল। তার দীর্ঘদিনের বন্ধু আরেক মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রনায়ক সোহেল রানা এক সাক্ষাৎকারে জানান, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি জড়িত ছিলেন রাজনীতির সাথে। ১৯৬৬ সালে যখন ছয় দফা দাবি উত্থাপিত হয়, তখন তিনি টগবগে তরুণ। যোগ দিলেন ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে। পড়ে গেলেন শাসকদের রোষানলে। পর পর কয়েকটি মামলা ঠুকে দেওয়া হলো তার নামে। কম নয়, ৩৭টি মামলার আসামি করা হয় তাকে।
এরপর ঊনসত্তরের আন্দোলনেও তিনি অংশ নেন। কেন কাঁচা বয়স থেকেই তার বিপ্লবীর রূপ— এই প্রশ্নের উত্তরে এক সাক্ষাৎকারে ফারুক জানিয়েছিলেন, তার বয়স যখন ছয় বছর, তখন বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য একবার চড় খেতে হয়েছিল। এরপর থেকেই নিজের ভাষা, নিজের বেড়ে ওঠা মাটির প্রতি দায়িত্ববোধ যেন বেড়ে যায়। আর তিনি মনে মনে পাকিস্তানের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন।
তার যুদ্ধে অংশ নেওয়াটাও সিনেমার মতো। পুরান ঢাকার দুলু তখন থাকেন শ্যামলীতে। কিন্তু বন্ধুবান্ধব সব পুরান ঢাকায়। তেমনই একজন মালিটোলার নাদের। এলাকায় যাকে ডাকা হতো গুণ্ডা নাদের নামে। এই গুণ্ডা নাদের হয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তাদের গেরিলা আক্রমণে নাজেহাল হানাদার বাহিনী।
২৫ মার্চকে কেন্দ্র তার স্মৃতির কথা একটি সাক্ষাৎকারে বর্ণনা করেছিলেন এই নায়ক। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশান সার্চলাইট’ পরিচালনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহর থমথমে। এই অবস্থায় নাদের ফারুকের শ্যামলীর বাসার পিছনে একটা ‘ওপেল’ গাড়ি নিয়ে আসে। তখন গাড়িতে করে নিয়ে আসা রাইফেল, পিস্তল দেখিয়েছিলেন ফারুককে। মানসিকভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। এরপর তিনি সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
ওদিকে তার সিনেমা ততদিনে তৈরি। ১৯৭১ সালেই মুক্তি পায় ফারুক-কবরী অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’। এরপরই বাংলার লাঠিয়াল আর মিষ্টি মেয়ে কবরী পর্দায় এলেই যেন তৈরি হয়ে যেতো আবেগের মোহমায়া। ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’। কেন্দ্রিয় চরিত্র না হলেও সেই থেকে ‘লাঠিয়াল’ বনে গেলেন তিনি দর্শকের চোখে। পেলেন পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার।
১৯৭৯ সালে ফারুক যেন পর্দার অপ্রতিরোধ্য নায়ক। এ বছর ‘নাগরদোলা’, ‘কথা দিলাম’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘ঘরজামাই’, ‘এতিম’, ‘ভাইভাই’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘মাটির পুতুল’সহ তার অভিনীত ত্রিশটির বেশি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। গ্রামের ছেলে মানেই যেন ফারুক, আর কেউ না।
তার অভিনীত ‘মিয়াভাই’ ব্যবসাসফল হলে তিনি বনে যান পর্দার ‘মিয়া ভাই’। কিন্তু তাতে পর্দায় তার রোমান্স থেমে থাকেনি। কবরী, সুচন্দা, শাবানা, ববিতা, রোজিনা, অঞ্জনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষসহ সত্তর ও আশির দশকের সব শীর্ষ নায়িকার নায়ক হয়েছেন তিনি। তবে ববিতার সাথে তার জুটি এতটাই মানিয়ে যায় যে সেসময় তাদের প্রেমের গুঞ্জনে কপির পর কপি বিক্রি হতো ফিল্মি ম্যাগাজিন।
দীর্ঘদিন পর্দায় রাজত্ব শেষে ধীরে ধীরে নিজের বয়সের সাথে মানানসই চরিত্রে অভিনয় করা শুরু করেন। নব্বই দশকের শেষে কয়েকটি চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তিনি পর্দায় ধরা দেন। তবে বেশিদিন তিনি ছিলেন না পর্দায়। অবসর নেন আনুষ্ঠানিকভাবে।
এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন প্রথমবারের মতো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
সোহেল রানার ভাষ্য অনুযায়ী, তার বন্ধু ফারুক যেমন লড়াকু ছিলেন তেমনই ছিলেন বাধ্য ও দায়িত্ববান। যে দলের হয়ে কাজ করেছেন, সেই দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদ সদস্য হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আসন আলোকিত করে গেছেন। সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার কথা ভাবেননি। এমনকি চিকিৎসার জন্য নিজের দুটো ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হয় বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছিল গণমাধ্যমকে।
চিত্রনায়ক ফারুক তার ভক্তদের মনে চির অমলিন কখনও ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানে, কখনও ’সুজন মাঝি’, কখনও ‘লাঠিয়াল’। আবার কখনও পুরান ঢাকার সেই দুষ্টু দুলু, যে একদিন দেশের প্রয়োজনে হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। এই সেই নায়ক, বাংলাদেশের যোদ্ধা, বাংলার যোদ্ধা।
২০২৩ সালের ১৫ মে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নায়ক ফারুক।