অক্টোবর মানেই স্তন ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর মাস। প্রতি বছরের মতো এবারও মাসজুড়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিতে সরব সংশ্লিষ্টরা। এ বছর এই বিশেষ মাসের প্রতিপাদ্য হলো— ‘স্তন ক্যান্সার নিয়ে কাউকে যেন একা লড়তে না হয়’। তবে এই সচেতনতার প্রচার শুধু একটি মাসে সীমাবদ্ধ রাখলে এর লক্ষ্য অর্জনে দেরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
স্তন ক্যান্সার সচেতনতা নিয়ে হ্যালোবিডি নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, প্রিভেন্টিভ অনকোলজিস্ট ড. মোহাম্মদ মাসুমুল হক। ২০১৪ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশে ক্যান্সার প্রতিরোধ বিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাহমিদা বৃষ্টি।
বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের সংখ্যা কেমন?
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে এখনও জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি নেই। তাই সুনির্দিষ্টভাবে কতজন নারী প্রতি বছর স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা কারও নেই। তথ্যের জন্য বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হয়। মোটাদাগে যদি দেখা হয়, তাহলে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১৬ হাজারের মতো নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী মৃত্যুবরণ করেন। তবে এটি অফিসিয়াল তথ্য নয়। এই সংখ্যাটা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের যেহেতু নিজস্ব তথ্য সংগ্রহের উপায় নেই, সেহেতু এই তথ্যটি ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর ক্যান্সার রিসার্চ থেকে উদ্ধৃত করে বলা। তথ্যের জন্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর ক্যান্সার রিসার্চের ওপর নির্ভর করতে হয়।
কোন শ্রেণির নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি এবং কেন?
এটি আসলে আলাদাভাবে ক্যাটাগরাইজড করে বলা খুব সহজ নয়। একটি সময় দেখা যেত, আমাদের দেশে শহরাঞ্চলের নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। কিন্তু এখন সারা বাংলাদেশে এই রোগে আক্রান্ত প্রচুর রোগী আছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও অনেক রোগী স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আসেন। সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তবে আমাদের দেশে এই চিত্র একেবারে ভিন্ন। এখানে চল্লিশোর্ধ নারীরা সবচেয়ে বেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
স্তন ক্যান্সার কেন হয়?
শহরে যারা বাস করেন তাদের বেশিরভাগই সেডেন্টারি জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। অর্থাৎ শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন। এদের মাঝে স্থূলতার বা অন্যান্য অনেক রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এই একই কারণে শহরের নারীরা স্তন ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
যেকোনো ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ক্যান্সারটি কেন হয় তা এককথায় বলা কঠিন। আমরা এক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলোর দিকে বেশি মনোনিবেশ করি। এই কারণগুলোকে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা দুটি ভাগে ভাগ করেন। একটি হলো মডিফাইঅ্যাবল অর্থাৎ যেগুলো প্রতিরোধযোগ্য। অন্যটি নন-মডিফাইঅ্যাবল বা যা প্রতিরোধ করা যায় না। স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে মডিফাইঅ্যাবল রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। এখানে সবার আগে বলতে হবে দেরিতে পরিবার গঠন বা বেশি বয়সে সন্তান গ্রহণের কথা। চিকিৎসকেরা ত্রিশ বছর বয়সের আগে বিয়ে এবং সন্তান গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পরিবার গঠনে যত দেরি হবে তত বেশি স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়বে।

স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস অক্টোবর
ওবেসিটি বা স্থূলতার কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর ডায়েটও অনেক বড় একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। যারা ভাজাপোড়া ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার বেশি খায় তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া যেসকল নারীদের খুব অল্প বয়সে মাসিক বা পিরিয়ড শুরু হয় এবং দেরিতে এটি বন্ধ বা মেনোপোজ হয় তাদেরও কোনো এক সময়ে গিয়ে স্তন ক্যান্সার হতে পারে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে গর্ভনিরোধক বড়ি সেবন করেন তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কারণ এ ধরনের বড়ি শরীরের হরমোনের মাত্রার তারতম্য ঘটায়। আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেড়েছে। এটিও স্তন ক্যান্সার হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। জর্দা, তামাক ইত্যাদি স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
এবার আসা যাক নন-মডিফাইঅ্যাবল অর্থাৎ অপ্রতিরোধযোগ্য ঝুঁকির কথায়। এগুলো হলো বয়স ও পারিবারিক ইতিহাস। বয়স বাড়লে যেকোনো ক্যান্সারের মতোই স্তন ক্যান্সারেরও ঝুঁকি বাড়ে। অন্যদিকে আছে পারিবারিক ইতিহাস। আমাদের সমাজে এই বিষয়টিকে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। যে পরিবারে মায়ের ক্যান্সার হয় সে পরিবারে মেয়েদের বেশ সামাজিক স্টিগমা বা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, পারিবারিক ইতিহাসের কারণে স্তন ক্যান্সার হলেও সেই পরিমাণটা খুবই কম। ৫ শতাংশের মতো। তাই বলতে হচ্ছে স্তন ক্যান্সারের ব্যাপারে আমাদের সবার স্টিগমা ভাঙ্গা উচিৎ।
এর লক্ষণগুলো কি?
স্তন ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণ হলো স্তন বা বগলে লাম্প বা গোটা, চাকা বা পিণ্ড হওয়া। এই লক্ষণটি নিয়েই আমাদের কাছে বেশিরভাগ নারী আসেন। ক্যান্সার অ্যাডভান্সড স্টেজের দিকে এগোতে থাকলে দেখা যায় চাকা বা পিণ্ডের কারণে স্তনের আকারের পরিবর্তন হতে থাকে। এমনকি রঙের পরিবর্তনও হতে পারে। আক্রান্ত স্তনের চামড়া কুঁচকে যায়। পাশাপাশি নিপল বা স্তনের বোটা ভিতরে ঢুকে যেতে পারে। নিপল থেকে রক্ত বা দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ নিঃসৃত হতে পারে। স্তন ক্যান্সার যদি শরীরে ছড়িয়ে যায় তখন লক্ষণ আরও তীব্র হয়। যেমন, মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গেলে তীব্র মাথাব্যথা বা রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করে। ফুসফুসে ছড়িয়ে গেলে শ্বাসকষ্ট, কাশি হয়। হাড়ে ছড়িয়ে গেলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এই লক্ষণগুলো দেখা গেলে অবশ্যই দ্রুত ক্যান্সার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ক্যান্সার নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ কিভাবে করা যায়?
প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সবার প্রথমে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যে ঝুঁকি ও লক্ষণগুলোর কথা বলা হয়েছে তা সবাইকে জানাতে হবে। লক্ষণগুলো দেখা গেলে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ ক্যান্সার আক্রান্ত নারীরা মৃত্যুবরণ করেন এই কারণে। তারা এমন একটি সময়ে চিকিৎসকের কাছে যান, তখন আর কিছু করার থাকে না।
পাশাপাশি যে সকল কারণে ক্যান্সার হতে পারে বিশেষ করে মডিফাইঅ্যাবল রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে। যেমন, সবার আগে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শরীরের ওজন বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী হতে হবে। এর জন্য আমাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে হবে। যেকোনো ধরনের ফাস্টফুড, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার— এগুলো খাওয়া যাবে না। প্রচুর শাক-সবজি, ফলমূল, আমিষ ও পরিমিত শর্করা জাতীয় খাবার খেতে হবে। অর্থাৎ সুষম খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে হবে। ধূমপান ও জর্দা ত্যাগ করতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে গর্ভনিরোধী বড়ি সেবন করা যাবে না।
এবার আসা যাক স্ক্রিনিংয়ের কথায়। ২০ বছর বয়সের পর থেকে নারীরা দুইভাবে এই কাজটি করতে পারেন। নিজে নিজে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে স্তন পরীক্ষা করা যায়। একে চিকিৎসার ভাষায় ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন (BSE) বলে। একজন নারী মাসিকের দশম দিনে বা যাদের অনিয়মিত মাসিক হয় তারা মাসের যেকোনো একটি সুনির্দিষ্ট দিনে এটি করতে পারেন। এখন ইউটিউবে এই সম্পর্কিত অনেক টিউটোরিয়াল আছে। এগুলো দেখে নিয়ম মেনে ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশনটি করা যাবে।
বয়স ৩৫ হয়ে গেলে প্রতি বছরে একবার একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্যে ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন করাতে হবে। ৪০ বছর বয়সের পর প্রতি তিন বছর অন্তর মেমোগ্রাম করাতে হবে। আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক নারী এগুলো সম্পর্কে জানেন না। অথবা জেনেও কাজগুলো করেন না। এ ব্যাপারে আমাদের বেশি করে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
এখানে একটি না বললেই নয়। অনেক নিয়ম মেনে চলার পরও কিন্তু ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে। কিন্তু প্রতি মাসে ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন, তিন বছরে একবার মেমোগ্রাম করলে ক্যান্সারটা অনেক আর্লি স্টেজে ধরা পড়বে। তখন কেবল ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে রোগী আজীবনের জন্য পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যেতে পারবেন। অর্থাৎ আমরা যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো মেনে চলি তাহলে স্তন ক্যান্সার হওয়া বা এতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারে কম।
বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা
পাঁচভাবে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা করা যায়। সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি। এটি নির্ভর করে ক্যান্সারের স্টেজের ওপর। আমাদের বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এর চিকিৎসা করাতে পারবেন।
প্রায় দশ বছর ধরে স্তন ক্যান্সারের সচেতনতা নিয়ে কাজ করছেন, সব শেষে জানতে চাই, এই বিশেষ মাস কেন ঘোষণা করা হলো? কেনই বা উদযাপন করা হয়?
স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস সর্বপ্রথম উদযাপন শুরু হয় ১৯৮৫ সাল থেকে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ও ইমপেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি (বর্তমানে অ্যাস্ট্রাজেনিকা)— এই দুই প্রতিষ্ঠান মিলে অক্টোবর মাসকে বার্ষিক আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য প্রচারাভিযানের জন্য নির্ধারণ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আর্লি ডিটেকশন বা প্রাথমিক শনাক্তকরণে মানুষকে পরিচিত ও উৎসাহিত করা। বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশেও এই মাসটিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপন করা হয়। এখানে মানুষকে স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ, এর কারণ, প্রতিকারের ব্যাপারে সচেতন করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্তন ক্যান্সার অপ্রতিরোধ্য হওয়ার আগেই তার লাগাম টেনে ধরার জন্যই এই বিশেষ মাসটিকে এখন বিশ্বজুড়ে গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা প্রতিকার চাই, হেরে যেতে চাই না কোনো অসুখের কাছে।