প্রতিবছর ব্রিটিশ অভিধান অক্সফোর্ড একটি নতুন শব্দকে বর্ষসেরা হিসেবে বেছে নেয়। ২০২৪ সালের সেরা শব্দ ‘ব্রেইন রট’ যার বাংলা ‘মস্তিষ্কের পচন’। ২০২৩-২০২৪ সালে শব্দটির ব্যবহার ২৩০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের মস্তিষ্কের ওপর নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া, শর্ট-ফর্ম কনটেন্ট, অনবরত স্ক্রলিং ও দ্রুত বিনোদনের প্রতি আসক্তি মানুষের চিন্তাশক্তি, মনোযোগ ও সৃজনশীলতাকে ক্ষয় করছে। এ ধরনের পরিস্থিতিকে বিশেষজ্ঞরা “ব্রেইন রট” বা “মস্তিষ্কের পচন” বলে অভিহিত করছেন। যদিও এটি মানসিক রোগ নয়, তবে এটি মনোযোগের স্থায়িত্ব কমিয়ে দিচ্ছে, গভীর চিন্তার ক্ষমতা লোপ করে এক ধরনের মানসিক স্থবিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু প্রিজিবিলস্কি বলেন, ‘শব্দটির জনপ্রিয়তাই বলে দেয় আমরা কেমন সময়ে বসবাস করছি। ব্রেইন রট আদৌ কোনো বাস্তব সমস্যা কি না, তা আমরা জানি না। অনলাইন জগতের প্রতি আমাদের অসন্তোষের বর্ণনা দেয় এই শব্দ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ঘিরে আমাদের দুশ্চিন্তার জানানও দেয় শব্দটি।’‘
সবকিছু মিলিয়ে এখন যদি আমরা ব্রেইন রটকে আধুনিক যুগের নীরব মহামরি বলি তাহলে খুব একটা ভুল হবে না। চাইলে আমরা এই পরিস্থিতি এড়াতে পারি। কিন্তু তার জন্য এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকতে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়া, শর্ট-ফর্ম কনটেন্ট, অনবরত স্ক্রলিং ও দ্রুত বিনোদনের প্রতি আসক্তি মানুষের চিন্তাশক্তি, মনোযোগ ও সৃজনশীলতাকে ক্ষয় করছে, ছবি: পেলোটন দ্য আউটপুট
ব্রেইন রটের লক্ষণ-
- দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা
- তথ্য গঠনে সমস্যা হওয়া
- নতুন কিছু শেখার প্রতি অনীহা
- দ্রুত বিরক্ত হয়ে যাওয়া
- বই পড়তে বা লম্বা আর্টিকেল পড়তে অসুবিধা হওয়া
- ক্রমাগত দ্রুত বিনোদনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া
ব্রেইন রটের যত কারণ
টিকটক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, ইউটিউব শর্টসের মতো সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীদের ছোট ও আকর্ষণীয় ভিডিওর মাধ্যমে
বিনোদন দেয়। এগুলো দ্রুত ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায়, যা আমাদের মস্তিষ্ককে আসক্ত করে ফেলে ও দীর্ঘমেয়াদি মনোযোগ কমিয়ে দেয়।
ইন্টারনেট আমাদের অগণিত তথ্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যা আমাদের মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত ব্যস্ত করে ফেলে। কিন্তু এই তথ্যের বেশিরভাগই আমাদের দীর্ঘমেয়াদে কোনো কাজে আসে না। ফলে আমরা তথ্য গ্রহণ করলেও তা প্রসেস করতে পারি না।
আগে যেখানে মানুষ বই পড়ে, গবেষণা করে বা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিত, এখন আমরা দ্রুত সার্চ করে উত্তর পেতে চাই। এর ফলে মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ ক্ষমতা কমে যায় এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা হ্রাস পায়।
ব্রেইন রট থেকে বাঁচার উপায়
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমানোর আগে ফোন এড়িয়ে চলুন।
- লম্বা সময় কোনো একটি কাজে ডুবে থাকার চেষ্টা করুন। পড়াশোনা, গবেষণা বা সৃজনশীল কাজ করার সময় ফোন ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখুন।
- নিয়মিত বই পড়া মস্তিষ্ককে তথ্য ধরে রাখার ও দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়।
- ব্যায়াম ও মেডিটেশন মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ও মনোযোগ বাড়াতে সহায়তা করে।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপও ব্রেইন রটের অন্যতম কারণ হতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো, সৃজনশীল কাজে যুক্ত হলে ব্রেইন রট থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারে।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অজান্তেই ঢুকে পড়েছে ব্রেইন রট, যা মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও চিন্তার গভীরতাকে প্রভাবিত করছে। প্রযুক্তির অতি-নির্ভরশীলতা মানসিক সক্ষমতা হ্রাস করছে, যা ভবিষ্যতে আরো বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তবে সচেতনতা ও সঠিক অভ্যাস গড়ে তোলা গেলে এই প্রবণতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন না, প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করুন।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, হেলথ, টাইমস অব ইন্ডিয়া।