Home সর্বশেষ ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ কীভাবে এলো

‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ কীভাবে এলো

মোহাম্মদ রবিউল্লাহ
১৩০ views

প্রতি বছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ পালিত হয়। বড়দিনের মতোই ধুমধাম করে পালিত হয় ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’। এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যা এক ধরনের ফসল কাটার উৎসবও বটে।

এই কারণেই দিনটি আমেরিকায় জাতীয় ছুটির দিন। বর্তমানে কানাডায় অক্টোবর মাসে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ পালিত হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে বড় আকারে পালিত হয় কানাডায় অত বড় পরিসরে পালন হয় না।

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ছাড়াও জার্মানি, ব্রাজিল, জাপানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দিবসটি উদযাপিত হয়। এদিন মানুষ একে অপরকে ধন্যবাদ জানানোসহ আগামী বছরের জন্য প্রার্থনা করেন।

এই বছর ২৮ নভেম্বর ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’। দিনটি উদযাপনের উদ্দেশ্য যেকোনো ধরনের সাহায্য বা সহযোগিতার জন্য কাছের বা অপরিচিত ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানানো। এদিন বাড়িতে পরিবার ও বন্ধুরা একসঙ্গে ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে দিনটি উদযাপন করেন।

‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র যাত্রা শুরুর কথা

‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র যাত্রা কখন শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা মত রয়েছে। প্রথমত, আমেরিকার লোকেরা বিশ্বাস করে যে এটি প্রথম ১৫৬৫ সালে ফ্লোরিডায় শুরু হয়েছিল। সেন্ট অগাস্টিন এই উৎসব প্রথম উদযাপন করেন। কিন্তু কিছু লোক বিশ্বাস করেন, প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ ১৬২১ সালে ইংরেজ উপনিবেশবাদীরা উদযাপন করেছিল।

 

খাবার দাবার

থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের দিনে খুব ভালো ভালো ও সুস্বাদু খাবার রান্না করা হয় বাড়ি বাড়ি, ছবি: হিন্দুস্তান টাইমস

 

দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় সেসব মানুষ যারা আমেরিকায় এসেছিলেন ও বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাদের হাত ধরেই এটির সূচনা বলে মনে করা হয়। আমেরিকায় প্রথম ফসল চাষ করার পর প্রতিবেশীদের ধন্যবাদ জানাতে তারা একটি পার্টির আয়োজন করেন, যা ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ নামে পরিচিত হয়।

তৃতীয়ত, ১৬২০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামক একটি জাহাজে চড়ে ১০২ জন নানা ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা ও তীর্থ করার জন্য ইংল্যান্ড ত্যাগ করে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। দুই মাস পর তারা আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস এসে পৌঁছান। তীর্থযাত্রীদের অনেকেই অনাহারে ও শীতের প্রকোপে অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন।

এর মধ্যে যারা সুস্থ ছিলেন তারা জাহাজ থেকে তীরে এসে নামেন। ওখানেই তারা একটি গ্রাম গড়ে তোলেন। এরপর তাদের স্কোয়ান্তো নামের এক আমেরিকান ইন্ডিয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই আদিবাসীই ওই তীর্থযাত্রীদের শিখিয়ে দেন কীভাবে ভূট্টা চাষ করতে হয়, মাছ ধরতে হয়, ম্যাপল সংগ্রহ করতে হয় এবং বিষাক্ত উদ্ভিদ এড়াতে হয়।

 

গিফট

বড়দিনের মতোই ধুমধাম করে পালিত হয় ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’, ছবি: জি নিউজ

 

১৬২১ সালের নভেম্বরে সেই তীর্থযাত্রীরা প্রথম ভুট্টা ফসল ফলাতে সফল হয়েছিল। সেই সময়ের গভর্নর উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড এই খুশি উপলক্ষে সব আদিবাসী ও তীর্থযাত্রীদের নিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন করেছিল, যা একটানা তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে সবাই প্রথমে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান তাদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা এবং শস্য দান করার জন্য। তারপর সবাই সবাইকে ধন্যবাদ জানান একে অপরকে সহযোগিতা করার জন্য। এই অনুষ্ঠানটিই আমেরিকার প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ ঘোষণা

১৭৮৯ সালে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ২৬ নভেম্বর প্রথম ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ ঘোষণা করেছিলেন। পরে আব্রাহাম লিঙ্কন নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবারে এই দিনটিকে স্থানান্তরিত করেন। তিনিই আবার ১৮৬৩ সালে লেখিকা সারাহ জোসেফ হালের ক্রমাগত অনুরোধে দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।

অনেকে আবার মনে করেন, দিবসটি উদযাপন করা শুরু করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ১৯৩৯ সালে তিনি শুরু করেন, যা ১৯৪১ সালে মার্কিন কংগ্রেসের স্বীকৃতি পায়।

 

প্যারেড

থ্যাঙ্কসগিভিং ডে প্যারেডের সময় ম্যানহাটনে বেলুন আকারে কুমড়ো ভাসছে, ছবি: লনলি প্লানেট

 

‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ঐতিহ্য

মার্কিন সংস্কৃতির অংশ ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ মূলত প্রতীকী একটি অনুষ্ঠান। আসলে পরস্পরের পাশে থাকা, বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং আগামী দিনগুলোর জন্য শুভেচ্ছা জানানোর উদ্দেশ্যেই বছরের পর বছর ধরে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

এদিন পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবাই একত্রিত হয়ে প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি সাফল্যের জন্য, দেশ ও জাতির সাফল্যের জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান। এই দিনে খুব ভালো ভালো খাবার রান্না করা হয়। খাবারের তালিকার প্রধান টার্কি রোস্ট। এছাড়া ক্র্যানবেরি সস, ক্যান্ডি, স্টাফিং, ম্যাশড পটেটো, ঐতিহ্যবাহী পামকিন পাই, আঙুর, স্টুর মতো সুস্বাদু খাবার থাকে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’র ভোজনে।

হোয়াইট হাউসে দুই টার্কির ক্ষমা

‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ উদযাপন করতে বাড়িতে বাড়িতে টার্কি মুরগির রোস্ট খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। এবার হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের হাত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল দুইটি টার্কি মুরগি। তবে ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ সামনে রেখে ২৫ নভেম্বর ‘পিচ‘ ও ‘ব্লসম’ নামের টার্কি মুরগি দুটির জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন বাইডেন।

হোয়াইট হাউসে প্রতি বছর ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’ সামনে রেখে প্রেসিডেন্টের টার্কি মুরগিকে ক্ষমা করার রীতি পালন করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ডেলাওয়ারের খামারে বড় হয়ে ওঠা টার্কি মুরগি ‘পিচ’ ও ‘ব্লসম’কে ওয়াশিংটন ডিসিতে আনা হয়।

 

ক্ষমাপ্রাপ্ত দুই টার্কি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ক্ষমাপ্রাপ্ত দুই টার্কি ‘পিচ‘ ও ‘ব্লসম, ছবি: দ্য হিল

 

হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে টার্কি দুটিকে প্রেসিডেন্টের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেন ন্যাশনাল টার্কি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান জন জিমারম্যান। সে অনুষ্ঠানেই তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর মধ্য দিয়ে এ মৌসুমে রান্না ঘরের আগুনে ঝলসানো থেকে রেহাই পায় পিচ-ব্লসম। বাইডেনের বাড়ি ডেলাওয়ার দুটি ফুলের নামে নামকরণ করা হয় টার্কি দুটির।

যুগে যুগে টার্কি মুরগির ক্ষমা

১৯৪৭ সাল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাড়িতে টার্কি মুরগি সরবরাহ করে আসছে দ্য ন্যাশনাল টার্কি ফেডারেশন। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উপহার হিসেবে টার্কি মুরগি গ্রহণের এ রীতি চালু হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের শাসনকাল থেকে। ট্রুম্যানই টার্কি ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে প্রথম টার্কি মুরগি গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি কখনোই এ মুরগি ছেড়ে দেননি। বরং উপহার হিসেবে পাওয়া সে মুরগি দিয়ে ভোজ সারতেন প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের সদস্যরা।

 

বাইডেন টার্কি ক্ষমা

হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে টার্কি উপহার দেন জন জিমারম্যান, ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট

 

লোকমুখে প্রচলিত আছে, প্রেসিডেন্টের ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকন প্রশাসনই প্রথম উপহার হিসেবে পাওয়া টার্কি মুরগি ছেড়ে দিয়েছিরেন। ‘থ্যাঙ্কস গিভিং ডে’তে ওই মুরগি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পরিবারের নৈশভোজ করার কথা ছিল।

লিংকনের ছোট ছেলে তার বাবাকে পোষা টার্কি মুরগি ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানানোর পর সে মুরগিকে আর ভোজের উপকরণ করা হয়নি। তবে এটি একেবারেই লোকমুখে প্রচলিত কথা, এর কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই।

১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডির শাসন মেয়াদে হোয়াইট হাউসে উপহার হিসেবে পাওয়া টার্কি মুরগি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। নথিভুক্ত থাকা প্রথম ঘটনা এটি। তবে সেটি কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা ঘোষণার অনুষ্ঠান ছিল না।

হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে টার্কি মুরগিকে ক্ষমা করার আনুষ্ঠানিক প্রচলন শুরু হয় মূলত ১৯৮৯ সাল থেকে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এটি শুরু করেছিলেন তখন। আর সে সময় থেকে হোয়াইট হাউসে এটি এক নিয়মিত আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।

তথ্যসূত্র: জিও নিউজ, সিএনএন ও হিন্দুস্তান টাইমস

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ