বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে অল্পকিছু পরিচালক আছেন যারা শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন না, বরং দর্শককে হাত ধরে নিয়ে যান অলীক এক স্বপ্নময় জগতে। যে জগত থেকে ফিরে আসলেও তার এক স্বপ্নিল রেশ থেকে যায় পুরো জীবদ্দশায়। সেই জগত এতই মোহনীয় যে আপনার কল্পনার মাত্রাকে ছাপিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।
মাস্টার ফিল্মমেকার হায়াও মিয়াজাকি ঠিক সেই গুটিকয়েক চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে একজন। তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শকদের কল্পলোকের দুনিয়ায় নিয়ে গিয়ে চিন্তা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করেন। তাঁর কাজকে চলচ্চিত্র সমালোচকরা যেভাবে মূল্যায়ন করে থাকে সেখান থেকে একটু সরে গিয়ে তাঁর দর্শনগত দিকটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
হায়াও মিয়াজাকি বিশ্বব্যাপী মানুষের মনে বাস্তব ও কল্পনার মাঝে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন। মিয়াজাকি তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানব জীবনের গভীর অর্থ, প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা এবং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার গুরুত্ব গভীরভাবে তুলে ধরেছেন।
১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া মিয়াজাকি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে বেড়ে উঠেছেন। যুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময়ে জাপানের আর্থ সামাজিক পুনর্গঠন তাঁর শৈশবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর বাবা ছিলেন একটি এয়ারক্রাফট কোম্পানির মালিক। মিয়াজাকির চলচ্চিত্রে উড়োজাহাজের ব্যবহারের কারণটা এখান থেকে বোঝা যায় । মেঘে মেঘে ভেসে থাকা শহর, পাখির মতো উড়তে পারে এমন চরিত্র কল্পনার জগত সৃষ্টি করাই তাঁর গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মিয়াজাকির চলচ্চিত্রগুলো মূলত পরিবেশ, প্রকৃতি ও সমাজের প্রতি একটি গভীর বার্তা নিয়ে আসে। দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার “থ্রোইনেস” (Thrownness) বা “নিক্ষিপ্ত অবস্থা” ধারণা ব্যবহার করে বলেন, মানবজীবন একধরনের বিপন্নতার মুখোমুখি হয়, যেখানে মানুষ নিজেকে বাস্তবতার মাঝে “নিক্ষিপ্ত” অবস্থায় আবিষ্কার করে। Spirited Away চলচ্চিত্রে ‘চিহিরো’ ঠিক এভাবেই হঠাৎ এক রহস্যময় জগতে নিক্ষিপ্ত হয়। সে তার পরিচিত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নতুন পরিবেশে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে।
চলচ্চিত্র সমালোচকরা এটিকে হাইডেগারের দর্শনের প্রতিফলন হিসেবে দেখেন, যেখানে চিহিরো’র মাধ্যমে মানুষের নিজের আত্ম-অন্বেষণকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া Spirited Away আধুনিক সমাজের ভোগবাদ ও লোভের একটি শক্তিশালী প্রতিফলন।

My Neighbor Totoro
মিয়াজাকির চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত কল্পনাশক্তি ও আধুনিক বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তিনি গভীরভাবে শিন্টো ধর্মের মতাদর্শ এবং মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত, যা প্রকৃতির প্রতি বিনম্রতা, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। উদাহরণস্বরূপ- My Neighbor Totoro চলচ্চিত্রে দেখা যায় নিরীহ, মায়াবী এক প্রাণী ‘টোটোরো’’। কিভাবে যেকোন পরিস্থিতিতে আশা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় শিশুদের কল্পনার জগতে খুব সূক্ষ্মভাবে এই চলচ্চিত্রটি কাজ করেছে। আমরা সবাই প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতি আমাদের মায়ের মতই আগলে রাখে এবং আমাদের অস্তিত্বহীনতা থেকে প্রকৃতি আমাদের রক্ষা করবেই সেটাই দেখানো হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
মিয়াজাকির কল্পনার জগত প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর “Idea of Forms” এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্লেটো বলেছিলেন, আমাদের দেখা এই বাস্তবতা প্রকৃত জগতের একটি ছায়া মাত্র। মিয়াজাকির বিশ্ব এমনই এক জগত যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনা এক হয়ে যায়। My Neighbor Totoro ছবিতে, আমরা দেখি দুটি শিশু কল্পনার জগতে টোটোরো’’র অস্তিত্ব যা প্লেটোর ধারণার প্রতিফলন। কারণ এখানে কল্পনা বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট।

My Neighbor Totoro
Howl’s Moving Castle সিনেমার মাধ্যমে তিনি যুদ্ধবিরোধী মনোভাব তুলে ধরেছেন, যেখানে এক তরুণ জাদুকর ও এক সাধারণ মেয়ের গল্প বলা হয়েছে। সিনেমাতে মিয়াজাকি যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে তীব্র সমালোচনা করেন। এই চলচ্চিত্রে, হাউল এক যাদুকর, কিন্তু যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে তিনি প্রেম ও সৌন্দর্যের খোঁজ করেন।
দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্রে বলতেন, “মানুষ স্বাধীনতা চায়, কিন্তু সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাকে দায়িত্ব নিতে হবে।” হাউল এই স্বাধীনতা ও দায়িত্বের দ্বন্দ্বে ভুগছেন, যা সার্ত্রের “Existentialism” এর সঙ্গে মিলে যায়।
চলচ্চিত্র সমালোচকরা একে স্ট্যানলি কুব্রিকের Paths of Glory কিংবা আকিরা কুরোসাওয়ার Ran সিনেমার সাথে তুলনা করেন, যেখানে যুদ্ধের অর্থহীনতা ও মানবিক সংকট স্পষ্ট দর্পনের মত কাজ করেছে। মিয়াজাকি নিজেও বলেছেন, “আমি যুদ্ধ ঘৃণা করি। যুদ্ধ মানেই মানুষকে ধ্বংস করা, আর যুদ্ধবিরোধী বার্তা ছাড়া কোনও শিল্পকর্মই মানবতার আসল সমস্যা তুলে ধরতে পারে না।

Howl’s Moving Castle
মিয়াজাকির কাজ ইকো-দার্শনিক চিন্তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। অ্যানিমেশনের বিশ্বে তিনি এমন এক শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা প্রথাগত গল্পের বাইরে গিয়ে প্রকৃতির গভীরতার সাথে সংযুক্ত। Princess Mononoke সিনেমাতে, মানুষের লোভ ও প্রকৃতির বিরোধ দেখা যায়। দার্শনিক টিমোথি মর্টন এই চলচ্চিত্রকে “ইকো-অপক্যালিপস” বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, মিয়াজাকি প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের হিংস্রতা তুলে ধরেছেন এবং প্রকৃতির প্রতিশোধকে একধরনের ন্যায়বিচার হিসেবে দেখিয়েছেন।
মিয়াজাকির চলচ্চিত্রে কোনও সরল দ্বৈততা নেই — এখানে কোনও চরিত্র পুরোপুরি ভালো বা মন্দ নয়। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞরা এটিকে “মোরাল গ্রে জোন” হিসেবে অভিহিত করেন, যেখানে চরিত্ররা নৈতিক জটিলতায় আবদ্ধ।
উদাহরণস্বরূপ, Nausicaä of the Valley of the Wind চলচ্চিত্রে নাউসিকার শত্রুরাও কেবলমাত্র নিজেদের রক্ষার জন্য লড়াই করছে। এই দ্বন্দ্ব দর্শকদের এক নৈতিক পরীক্ষায় ফেলে দেয়, যা দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের “Categorical Imperative” এর ধারণার প্রতিফলন। যেমন Lady Eboshi চরিত্রকে পরিবেশের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করেন, তেমনি তাঁর মধ্যে মানবতারও ছাপ রাখেন। এই জটিলতাই মিয়াজাকির চলচ্চিত্রের গভীরতা তৈরি করে, যেখানে কোনও সহজ সমাধান খুঁজে পায় না মানুষ, বরং একটি নৈতিক ধাঁধার মুখোমুখি হতে হয়।
মিয়াজাকি কখনোই সরাসরি আদর্শ কিংবা মতাদর্শ দর্শকদের উপর আরোপ করেননা। তাঁর চলচ্চিত্রে নেই কোনও সরল দুষ্ট ও মহান চরিত্রের বিভাজন। বরং তিনি মানুষকে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় নিমজ্জিত করেন। Nausicaä of the Valley of the Wind সিনেমাতে দেখা যায়, প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মানবজাতি নিজের ধ্বংসের পথ তৈরি করছে। তবে একইসঙ্গে মিয়াজাকি বিশ্বাস করেন, মানুষ আবারও পথ খুঁজে পাবে — এই বার্তাটি অত্যন্ত ইতিবাচক।
মিয়াজাকির কাজের গভীরতা শুধু গল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা মানুষের চিন্তাধারা ও ভাবাদর্শকে পরিবর্তন করে দেয়। চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট বলেছিলেন, “মিয়াজাকি আমাদের দেখান, কল্পনার মাধ্যমে আমরা আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারি এবং প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেতে পারি।” আবার দার্শনিক হানাহ আরেন্টের “The Human Condition” এর আলোকে তাঁর কাজকে বিশ্লেষণ করলে, আমরা বুঝতে পারি যে মিয়াজাকির চলচ্চিত্র মানুষের সৃজনশীলতা ও কল্পনার ক্ষমতাকে উদযাপন করে, যা মানবজাতির অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।
মিয়াজাকির জীবনের অজানা দিক
- মিয়াজাকি একবার বলেছিলেন যে তিনি আসলে কোনো “ম্যাজিক্যাল” জগত তৈরি করেন না, বরং তিনি এমন একটি জগত দেখান যা আমাদের নিজেরই হতে পারে, যদি আমরা কল্পনাকে প্রাধান্য দিই।
- তাঁর স্টুডিও জিবলি (Studio Ghibli) নামটি এসেছে “ঘিবলি” শব্দ থেকে, যা একটি ইতালিয়ান শব্দ; অর্থ হলো “মরুভূমির বাতাস”। মিয়াজাকি মনে করতেন তাঁর কাজ বিশ্ব চলচ্চিত্রে এক নতুন বাতাসের মতো পরিবর্তন আনবে।
- মিয়াজাকি নিজ হাতে সব অ্যানিমেশন চিত্র আঁকতেন। তিনি সবসময় ডিজিটাল প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ তিনি মনে করেন হাতে আঁকা চিত্রেই প্রাণ আসে।
- Spirited Away সিনেমার কাজ শেষ করার পর, তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু বারবার কাজে ফিরে আসেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে “এখনও অনেক গল্প বলা বাকি”।
মিয়াজাকির কাজ শুধু জাপানের অ্যানিমেশনের জগতে নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলো আমাদের শিখিয়েছে যে জীবনের প্রতি ভালোবাসা এবং কল্পনা আমাদের জীবনের গভীর সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ। মিয়াজাকি আমাদের দেখান, কিভাবে ছোট ছোট আনন্দের মাঝে আমরা জীবনের বড় অর্থ খুঁজে নিতে পারি।
মিয়াজাকি কখনোই নিজেকে শুধুমাত্র একজন পরিচালক হিসেবে দেখেন না। তিনি এক দার্শনিক, গল্পকার, এবং মানবতার সৈনিক। তাঁর কাজ আমাদের প্রতিদিনের জীবন থেকে তুলে নিয়ে যায় এক নতুন এক জগতে , যেখানে কল্পনা আর বাস্তবতা মিলে এক অভূতপূর্ব জগৎ তৈরি করে।
এই পৃথিবীতে, যেখানে প্রযুক্তির দৌড় আমাদের মানবিক অনুভূতিগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে, মিয়াজাকির কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই অমলিন স্বপ্নের কথা যা আমরা ছোটবেলায় দেখতাম। তাঁর কাজ আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে, নতুন করে বাঁচতে শেখায়, এবং সবকিছুর মাঝে নতুন করে আশার আলো দেখায়।
মিয়াজাকির সর্বশেষ ছবি The Boy and the Heron নেটফ্লিক্সে দেখা যাচ্ছে। চাইলে মিয়াজাকি এবং Ghibli Studio আরও ২২টি ছবি দেখে আসতে পারেন নেটফ্লিক্স থেকে।