শাহরুখ খানের বড় ছেলে আরিয়ান খানের ক্যামেরার পেছনে অভিষেক হয়েছে। মেয়ে সুহানা খান ইতিমধ্যে তারকা বনে গেছেন। সাইফ আলী খান ও অমৃতা সিংয়ের কন্যা সারা আলী খানও এখন তারকা। তাদেরও আগে, কাপুর বংশ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তারা বড়ই হন বলিউডে রাজত্ব করার জন্য। পৃথ্বীরাজ কাপুর থেকে শুরু করে রনবীর কাপুর— প্রতি প্রজন্মে একাধিক তারকা। তাহির হুসেন থেকে আমির খান, জুনায়েদ খান— সবাই বলিউডের নাম করা মুখ। অথচ ভারতের ‘সমুদ্রসম’ তারকা দিলীপ কুমারের পরিবার থেকে কোনো তারকা হওয়ার সম্ভাবনাটিও নেই। আজীবন সিনেমাকে নিজের সন্তান মনে করা দিলীপ পৃথিবী ছেড়ে গেছেন নিঃসন্তান অবস্থাতেই।
কয়েক বছর ধরে চলা নেপোটিজমের তর্ক থেকে ভারতবর্ষের এই মহানায়ক তাই অনেক ঊর্ধ্বে। তাকে নিয়ে কোনো স্ক্যান্ডালে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যা থেকে এ যুগের দিলীপ বলে খ্যাত শাহরুখ খানও বাঁচতে পারেননি।
তবে এমন অনেক কিছুই আছে দিলীপ কুমারের উৎসবমুখর জীবনে যা শব্দ দিয়ে বাঁধা মুশকিলই বটে, যার কিছুটা অনেকেই জানেন। যেমন- তার আসল নাম। দিলীপ কুমারের আসল নাম ইউসুফ খান। তিনি পেশোয়ারী। ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানে তার জন্ম। লালা গোলাম সারওয়ার খান এবং আয়েশা বেগমের ১২ সন্তানের অন্যতম ছিলেন। ফলের বাগান ছিল বাবার। সেই সূত্রে বলা যেতে পারতো, ‘ফল ব্যবসায়ী ছেলের ভারত জয়।’
তবে তার পরিচয়ের বিশালতার কাছে কখনও অন্য কোনো পরিচয় বেশি ফুটে ওঠেনি। নিজের পরিচয়েই অনন্য এক তারকা দিলীপ কুমার। তার গল্পের শুরুটা অবিভক্ত উপমহাদেশের। তখন ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল, আলাদা হয়নি দেশ। ১৯৪০ ভারতের মহারাষ্ট্রে চলে আসে তার পরিবার। ফলের ব্যবসা থেকেই এই দ্বার খুলে যায় তাদের জন্য। ডাক ছিল পুণে থেকে। আর প্রস্তাব ড্রাইফ্রুট নিয়ে কাজ করার। অনেকেই হয়তো জানেন না, রাজ কাপুর এবং দিলীপ কুমার কিন্তু আগে থেকেই বন্ধু, সেই ছোটবেলা থেকে। কিভাবে? পেশোয়ারে পাশাপাশি বাসায় থাকতেন তারা। খালাসা কলেজে একসাথে পড়েছেনও। তখন তারা একসাথে ঘোড়ার গাড়িতে করে চড়ে বেড়াতেন বলে স্থানীয়রা এখনও বলাবলি করেন।
ভারতে চলে আসার পর কাজ খোঁজার জন্য প্রযোজনা সংস্থা বোম্বে টকিজে যাতায়াত ছিল তার। তখনই দেবীকা রানীর চোখে পড়ে যান তিনি। প্রস্তাব করেন সিনেমা করার। কিন্তু ঠিক সেই সময় ইউসুফ নামে শুরু করাতে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। তখন দেবীকা রানীর পরামর্শে সুপরিচিত হিন্দি কবি নরেন্দ্র শর্মা কিছু নাম প্রস্তাব করেন। এর মাঝে ‘জাহাঙ্গীর’, ‘ভাসুদেব’ ও ‘দিলীপ কুমার’— এই তিনটি নাম থেকে দিলীপ কুমার নামটিই বেছে নেন। আর তাতেই রচিত হয় ইতিহাস।
আবার দিলীপও ভাবলেন বাবার হাত থেকে বাঁচার একটাই উপায়— নাম পরিবর্তন। কারণ বাবা কখনোই তাকে সিনেমায় অভিনয় করার অনুমতি দেবেন না বলে ধারণা ছিল তার। ফলে অন্য নামেই প্রথম ছবিতে কাজ করা শুরু করেন। ছবিটির নাম ‘জোয়ার ভাটা’। তবে প্রথম ছবিতে তিনি সাফল্য পাননি। দ্বিতীয়, তৃতীয় ছবিতেও নয়। নূর জাহানের সঙ্গে চতুর্থ ছবি ‘জুগনু’ দিয়ে সাড়া ফেলেন দিলীপ কুমার। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। রাজত্ব করেছেন নিয়মিত। সেই সময়ে বলিউডের ভিত্তি গড়তে রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার ও দেব আনন্দকে একসাথে বলা হতো ত্রিমূর্তী।
এরপর তার যে উপাধি, সেই উপাধি অর্জন করেন তিনি ‘দিদার’ সিনেমার মাধ্যমে। আর তা হলো ‘ট্র্যাজেডি কিং’। ‘দিদার’ সিনেমাতে তার সাথে আরও অভিনয় করেন নারগিস, অশোক কুমার ও নিম্মি। এই কিং গড়ে তুললেন নিজের রাজত্ব।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতের বাসিন্দা হয়ে যাওয়া দিলীপ আর ফেরেননি তার রাজত্ব ছেড়ে। যে রাজত্বে তিনি যুবরাজ ‘সেলিম’। উল্লেখ্য, মধুবালার সাথে অভিনয় করা ‘মুঘল-ই-আজম’ তার একমাত্র সিনেমা, যেটাতে তিনি অনস্ক্রিন চুমু খেয়েছেন কোনো সহশিল্পীকে।
দিলীপ কুমারের আরেকটি শক্তি ছিল মোহাম্মদ রফি। বাংলাদেশের কিংবদন্তি রুনা লায়লাও বলেছেন, রফি সাহেবের কণ্ঠ শুনলেই দিলীপ কুমারের চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। অথচ অনেকেই হয়তো জানেন না, লতা মুঙ্গেশকরের সাথে গানও করেছেন হৃষিকেষ মুখার্জির মুসাফির ছবির জন্য। গানটি তৈরি করেন সলিল। কোহিনূর সিনেমার জন্য তিনি শিখেছেন সেতার, শুধুমাত্র অভিনয়ের সময় যেন সত্য মনে হয়।
এই নিষ্ঠার কারণেই তিনি সকলের কাছে আজও পূজনীয়। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী ফোন করে কথা বলতে চান। শেষে বাজপেয়ী নওয়াজ শরিফকে বলেন, ‘আমি চাই, আমার পাশে বসা একজনের সাথে আপনি কথা বলুন, যিনি আমাদের আলোচনা শুনেছেন।’ পাশে বসা সেই লোকটি ছিলেন দিলীপ কুমার, যিনি নওয়াজ শরিফকে অনুরোধ করেন দুই দেশের উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি ফেরাতে পদক্ষেপ নিতে।
দিলীপ কুমার ১৯৫৪ সালে ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার গ্রহণ করা প্রথম ব্যক্তি এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পাওয়ার ইতিহাস তার ঝুলিতে। এই অভিনেতা মোট আটটি বিভাগে পুরস্কার জিতেছেন। সমালোচকদের মতে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় অভিনেতা যিনি এই বিরল সম্মানের অধিকারী।
কিন্তু চাঁদেরও যেমন কলঙ্ক থাকে, দিলীপ কুমারের আছে ছোট্ট একটু ক্ষত। দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করা পার্বতীর কপালে সেই কাটা দাগ যেমন তেমন। আর তা হলো মধুবালার সাথে প্রেম। সাতটি সিনেমাতে নারগিসের সাথে অভিনয় করেও যে প্রেম হয়নি, সেই প্রেম হয়েছে ‘যাব পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’ গানের ছবিতে চোখে চোখ রেখে। হ্যাঁ, ‘মুঘল-ই-আজম’ই সেই ছবি, দিলীপ যে ছবিতেই কেবল মুসলমানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এবং এটিই সেই ছবি, যে ছবিতে অভিনয়ের সময় মধুবালাকে বিয়ে করতে চান তিনি। তবে মধুবালার বাবার সাথে মন কষাকষি হওয়াতে মধুবালাই তাকে বিয়ে করতে রাজি হননি। বয়সের পার্থক্য নিয়েও বলেছিলেন মধুর বাবা। সেই দিলীপই ২২ বছরের ছোট সায়রা বানুকে বিয়ে করেন।
আর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা যান মধুবালা। মারা যাওয়ার আগে দিলীপের সাথে কথা বলে, শুভ কামনা জানিয়ে বলেন, ‘প্রিন্স, অতঃপর খুঁজে পেলো তার প্রিন্সেস…।’
অনেকের ধারণা মধুবালাও দিলীপের প্রেম ভুলতে পারেননি। আর তার ব্যক্তি জীবনকেও সুখের করতে পারেননি বলেই এত অল্প বয়সে ক্ষয়ে গেছেন।
সব গল্পের শেষ নেই, প্রেমের শেষ নেই। আবার কোনো কবিতা হঠাৎই শেষ হয়ে যায়। দিলীপ কুমারের জীবনে অসমাপ্ত প্রেম থাকলেও তার গল্পটি ২০২১ সালের ৭ জুলাই থেমে যায়। নেই কোনো পরের গল্প, উত্তরসুরী। ‘যাহা‘ ছিল তা নিয়েই গেল দিলীপের তরী…।