Home মুখোমুখি ‘গত ১২ বছরে জ্বালানির দাম বেড়েছে ৪০০ শতাংশ’

‘গত ১২ বছরে জ্বালানির দাম বেড়েছে ৪০০ শতাংশ’

ইকবাল হোসেন
৮৫ views

ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট তাসকীন আহমেদ। দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের সার্বিক অবস্থা, শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, ভ্যাট ব্যবস্থাপনা, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, বিনিয়োগ পরিবেশ-সহ নানা বিষয়ে হ্যালো বাংলাদেশের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন এ ব্যবসায়ী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার ইকবাল হোসেন। 

বর্তমানে দেশের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে কি বলবেন?

নতুন সরকার আসার পর প্রথম দুই-তিন মাস যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় করেছি সেগুলো আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। কিন্তু গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের অবস্থা এপ্রিল-মে মাসে এসে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে আরও নজর দিতে হবে। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের মনের ভেতরে এ নিয়ে আস্থা থাকতে হবে। মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আস্থার সংকট রয়ে গেছে। এ ছাড়া জ্বালানির দাম ও মুদ্রা বাজারের বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। 

গত ৮ মাসে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য খাত। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঢাকা চেম্বার কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে?

ঢাকা চেম্বার বাংলাদেশের অন্যতম পুরাতন অ্যাসোসিয়েশন। আমরা সবসময় সরকারের সমালোচক হিসেবে বেসরকারি খাতের স্বার্থে প্রতিটি ব্যবসায়িক সেক্টরের জন্য আওয়াজ তুলে থাকি।
বর্তমান সরকার একটা কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে প্রতিটা সেক্টরে (যেমন- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বেসরকারি খাতের অর্থায়ন, আর্থিক খাত, শিল্প খাতের উন্নয়ন, জ্বালানি খাত) নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। উপদেষ্টাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছি, বিভিন্ন  সেমিনারে তাদের ডাকছি। ঐতিহাসিকভাবে আমরা প্রতিবছর বাজেট নিয়ে বড় ইভেন্ট করে থাকি। অর্থ উপদেষ্টা ও এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে লিখিতভাবে ঢাকা চেম্বারের বাজেট প্রস্তাবগুলো দিয়েছি।

শিল্প খাতে জ্বালানির দাম (গ্যাস) বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের কতটা ভোগাচ্ছে?

এ অবস্থাটা যথেষ্ট সিরিয়াস ও জটিল। বিনিয়োগকারীরা যখন কোন নতুন বিনিয়োগ করেন, তারা ৫ থেকে ১০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে নামেন। যেকোন ইন্ডাস্ট্রি করার ক্ষেত্রে পাওয়ার সাপ্লাই, জ্বালানি নিরাপত্তা ও দামের বিষয়গুলো দেখা হয়। গত ১০ বছরে দেখেছি ১১ বার গ্যাসের দাম বেড়েছে। গত ১২ বছরে জ্বালানির দাম ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। গার্মেন্টেস, সিমেন্ট, স্টিল, ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু করে প্রায় সব সেক্টরের ব্যবসায়ীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অবশ্য সব ব্যবসায়ী সবসময় লাভে থাকবে না এমনটা নয়, সমস্যা আসতেই পারে।
সবসময় সরকারকে বলে থাকি ১০ বছরের একটা প্রাইসিং (দাম) স্ট্র্যাটেজি (সুপরিকল্পিত কর্মপদ্ধতি) দিতে। কি রকম দাম থাকবে। এ রকম হঠাৎ করে ২০, ৩০, ৪০ শতাংশ দাম বাড়ানো উচিত না। কোন ব্যবসায়ী এ নিয়ে প্রস্তুত ছিল না। তাই সব সেক্টরের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জিং সময়। সব সেক্টরে পর্যাপ্ত জ্বালানি পাওয়া ও জ্বালানির দাম নিয়ে আতঙ্কে আছে ব্যবসায়ীরা। এ সমস্যা থেকে এক রাতেই মুক্তি মিলবে বলে মনে করি না। সরকার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানির মান ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বেশ কিছু বিজনেস সেক্টর আছে তারা বলছে দাম বাড়ান, কিন্তু জ্বালানি নিরাপত্তা বা সরবরাহ নিশ্চিত করুন। 

1 2

তাসকীন আহমেদ। ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ

দেশে বিদ্যমান ভ্যাট ও আয়কর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল, ব্যবসায়ীদের হয়রানির শিকার হতে হয়, এ থেকে কিভাবে পরিত্রাণ মিলবে? 

ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে ইউনিফাইড ভ্যাট সিস্টেম চালুর দাবি জানিয়েছি। বাজেটে উৎসে করের হার যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা, মূসক হার সিঙ্গেল ডিজিটে নির্ধারণ ও অনানুষ্ঠানিকখাতের জন্য ১ শতাংশ হারে মূসক নির্ধারণ এবং ভ্যাট আপ চালুর প্রস্তারের পাশাপাশি সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশের উন্নয়ন হবে, সেই সঙ্গে বাড়বে সরকারের রাজস্ব আহরণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া, সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কমের তালিকায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। আমাদের ২ শতাংশ থেকে শুরু করে ৭ বা ৮ স্ল্যাবে ভ্যাট আছে। এটিকে আধুনিকায়ন করে পুরোপুরি ডিজিটালাইজ করে নিতে হবে। ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি দূর করতে হবে। এ জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ব্যবসায়ীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।  

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক আরোপ দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে কতটা প্রভাব ফেলবে? এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?

ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বিশ্ব বাণিজ্যকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব  বাণিজ্য সংস্থা বিভিন্ন রিপোর্টে বলেছে এ কারণে আগামীতে বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি রয়েছে। আমাদের জন্য আমেরিকার চেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। আমেরিকা  চীনকে প্রতিহত করছে। চীনের জন্য আমেরিকার বাজার বন্ধ হয়ে গেলে তারা ইউরোপের বাজারে আরো এগ্রিসিভ হয়ে যাবে। এতে আমাদের ইউরোপের বাজারে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিযোগিতার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের উচিত এখন আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে সমঝোতার চেষ্টা করা।  

দেশে বর্তমানে বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন? ব্যবসার পরিবেশ উন্নতির জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি?

বর্তমান অবস্থার জন্য আমরা সবাই দায়ী। এজন্য বর্তমান সরকার দায়ী, তাও না। জ্বালানির দাম বাড়ায় সরকারকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির ৮৫ শতাংশ বেসরকারি খাতের উপর  নির্ভর। বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে কোনো নীতি গ্রহণ করলে তা ফলপ্রসূ হবে না। এ মুহূর্তে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা, জ্বালানির দাম স্থিতিশীল ও সরবরাহ ঠিক রাখা এবং মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ বিষয়গুলোতে যদি সরকার যথাযথভাবে নজর দিতে পারে তাহলে ছয় মাসের মধ্যে আমরা ভালো অবস্থানে ফিরে আসব। 

2 1

তাসকীন আহমেদ। ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ

এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোন কোন খাতে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

গত ৫ বছরে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী যে প্রস্তুতি দরকার ছিল তা বাংলাদেশ নিতে পারেনি। পলিসিগতভাবে সরকার ও বেসরকারি খাত কোন প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এজন্য দুই থেকে তিন বছর এটি পিছিয়ে দেওয়া উচিত। 

আগামী অর্থ বছরের বাজেট নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কি?

আমরা আশা করছি এবারের বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে। একাধিকবার অর্থ মন্ত্রণালয়, ব্যাংকিং সেক্টর, এনবিআরের সঙ্গে বসেছি। কিছু কিছু জটিল বিষয় যেগুলো ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, সেগুলো দূর হবে বলে আমরা আশাবাদী। 

ঢাকা চেম্বার ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কি ধরনের কাজ করে থাকে?

ঢাকা চেম্বারের লক্ষ্য হলো বিজনেস সেক্টরকে প্রতিনিধিত্ব করা। ব্যবসার পরিবেশ উন্নতির জন্য যে সরকার থাকে আমরা তাদের গঠনমূলক সমালোচনা করব। এটা সরকারের বিপক্ষে না বরং সরকার কিভাবে এগিয়ে যেতে পারে, সেজন্য ঢাকা চেম্বার কাজ করে। আমাদের কাজই হলো বেসরকারি খাতের পক্ষে আওয়াজ তোলা।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ