আলঝেইমার মস্তিস্কের এক ধরনের রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কিছু মনে রাখতে পারেন না। বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে এই রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুরুর দিকে অনেক সময়ই ধরা পড়ে না। কারণ এই রোগের লক্ষণ অন্যান্য অসুস্থতার ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে।
সাধারণত প্রবীণদের মধ্যে এই রোগ দেখা যায়। কিন্তু ২০২৩ সালে চীনের এক কিশোর মাত্র ১৯ বছর বয়সে এই ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হয়। এমন ঘটনায় চিকিৎসকরা যেমন হতবাক, তেমনি আলোড়ন তুলেছে বৈজ্ঞানিক মহলেও।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের একটি নিউরোলজি মেমোরি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন এই কিশোর ১৭ বছর বয়সে প্রথমবার স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা অনুভব করে। ধীরে ধীরে তার অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছায়, যেখানে একদিন আগের ঘটনাও সে মনে রাখতে পারত না। ফলে ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। প্রায়ই সে নিজের জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলত। যে কারণে সে হাইস্কুলের গন্ডি শেষ করতে পারেনি।
মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা ও গবেষণার ফলাফল
মেডিক্যাল স্ক্যানে দেখা গেছে এই কিশোরের মস্তিষ্কের ‘হিপোক্যাম্পাস’ নামক গুরুত্বপূর্ণ অংশটি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। যা সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে তার মেরুদণ্ডের তরলেও আলঝেইমারের নির্দিষ্ট প্রোটিন পাওয়া গেছে।
চিকিৎসকরা প্রথমে ভেবেছিলেন এটি ফ্যামিলিয়াল আলঝেইমার ডিজিজ (FAD)।
আলঝেইমার সাধারণত বয়স্কদের রোগ, ছবি : ডিমেনটেক
আলঝেইমার সাধারণত বয়স্কদের রোগ হলেও ৬৫ বছরের নিচে যাদের এই রোগ হয় তাদেরকে এলি-অনসেট আলঝেইমার রোগী বলা হয়। যা মোট রোগীর প্রায় ১০ শতাংশ। ৩০ বছরের নিচে যারা আক্রান্ত হন তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত পারিবারিক জেনেটিক কারণে (Familial Alzheimer’s Disease বা FAD) হয়ে থাকে। এসব রোগীদের শরীরে নির্দিষ্ট কিছু জিনে ত্রুটি থাকে। যা এই রোগের কারণ হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে জিনগত পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা কোনো পরিচিত মিউটেশন বা জিনের ত্রুটি খুঁজে পাননি এই কিশোরের। এমনকি তার পরিবারেও কারও মধ্যে আলঝেইমারের ইতিহাস নেই।
এর আগে সবচেয়ে কম বয়সে আলঝেইমারে আক্রান্ত রোগী ছিলেন ২১ বছর বয়সী। যিনি PSEN1 নামক একটি ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করতেন। কিন্তু ১৯ বছর বয়সী এই কিশোরের ক্ষেত্রে সেই জিনও নেই। অর্থাৎ তার রোগের পেছনে কোনো পরিচিত জেনেটিক ব্যাখ্যা নেই।
এক বছর ধরে পর্যবেক্ষণের পর দেখা গেছে তার বয়সী অন্যদের তুলনায় তার স্মৃতিশক্তি ৮২ শতাংশ কম। আর তাৎক্ষণিক স্মৃতি কমেছে ৮৭ শতাংশ। এমন ফলাফল চিকিৎসকদের অবাক করেছে।
আলঝেইমার রোগ এখন তরুণদেরও
চিকিৎসক জিয়ানপিং জিয়া এবং তার দল এই কিশোরের কেস রিপোর্টে লিখেছেন, এই রোগী আমাদের আলঝেইমার রোগ সম্পর্কে দীর্ঘদিনের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাদের মতে এই রোগ শুধু বার্ধক্যের সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। বরং আরও জটিল ও গভীরভাবে আমাদের গবেষণা প্রয়োজন।
তারা আরও বলেন এই ধরনের রহস্যজনক কেস ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে আলঝেইমার কীভাবে শুরু হয় তা বুঝতে নতুন করে গবেষণার দরজা খুলতে হবে।
এই ঘটনাটি প্রমাণ করে আলঝেইমার শুধু বয়স বাড়লে হয় না। এটি অনেক জটিল এবং নানা পথ ধরে মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত হানে।
গবেষকরা বলছেন ভবিষ্যতে তরুণদের আলঝেইমার নিয়ে আরও গবেষণা করা উচিত। যুবকদের মধ্যে আলঝেইমারের রহস্য উদঘাটন করা হতে পারে ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ। তারা বলেন, বিজ্ঞান এখনো সব জানে না। তরুণ বয়সে আলঝেইমারের মতো রোগ দেখা দিলে আমাদের গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আর এটাই হতে পারে ভবিষ্যতের অন্যতম বড় মেডিক্যাল রহস্যের সমাধানের পথ।
সূত্র : সাইন্স এ্যালার্ট
