দেশে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। কোলন ক্যান্সার বা কোলোরেক্টাল ক্যান্সার পরিপাকতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। এই ক্যান্সার বৃহৎ অন্ত্র থেকে শুরু হয়ে কোলনে পৌঁছায়, যা পাচনতন্ত্রের শেষ অংশ। এ ধরনের ক্যানসার সাধারণত কোলনের ভেতরে ছোট পলিপ হিসেবে শুরু হয়। সময়ের সাথে সাথে এই পলিপগুলো ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
সাধারণত বয়স ৫০ পেরোলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তবে বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তরুণদের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কেনো বাড়ছে, ঝুঁকি কমাতে জীবন-যাপনে কি ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এবং লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুশফিকুর রহমান চৌধুরী।
এই বিশেষজ্ঞের মতে তরুনদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ার অন্যতম কারণ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। কোলন ক্যান্সার এমন কিছু অভ্যাসের ফল। অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, তামাক, ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বংশগত কিছু উপসর্গ ও পারিবারিক ইতিহাস এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে কোলন ক্যান্সার বিশ্বে তৃতীয়।
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিবছর কোলন ক্যান্সারের প্রায় ১৫-২০% রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। যদিও বাংলাদেশে এই ক্যান্সারের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তবে শহরাঞ্চলে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ
নিয়মিত মলত্যাগ না হওয়া। ক্রমাগত ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য। পায়ুপথে বা মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া। মলদ্বারে রক্তপাত কোলন ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। অর্শ্বের সমস্যায়ও মলদ্বারের রক্তপাত হয়। তবে এই রক্তপাতের মধ্যে রয়েছে তারতম্য। অর্শ্ব রোগীদের ক্ষেত্রে যে রক্তপাত হয়, তা সাধারণত লাল। অপরদিকে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগিদের ক্ষেত্রে এই রক্ত কালচে রংয়ের হয়। কালচে রং দেহের অভ্যন্তর থেকে নির্গত রক্তের সূচক।

কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকিঁ কমায় পান্তা ভাত, ছবি: টাইমস অব ইন্ডিয়া
এ ছাড়া পেটে অস্বস্তি ভাব- যেমন গ্যাস, পেট ফুলে থাকা, পেট মোচড়ানো, পেট ফাঁপা ভাব ইত্যাদি থাকা। ধীরে ধীরে ওজন কমে যাওয়া। রক্তশূন্যতা দেখা দেওয়া। মলত্যাগের পরও পেট পুরোপুরি খালি হয়নি, এমন বোধ হওয়া। এগুলো সাধারণ লক্ষণ। ক্যান্সার কোলন থেকে ছড়িয়ে শরীরের অন্য কোথাও গেলে, যেমন-লিভারে গেলে ব্যথা হতে পারে। ফুসফুসে গেলে কাশি হতে পারে। এমনকি হাড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ক্যান্সার কোষ।
রোগ নির্ণয়
সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা কোলনস্কোপি ও বায়োপসি। বায়োপসির মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয়ের পর সিটি স্ক্যান, রক্তে এন্টিজেনের পরিমাণ ইত্যাদি বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের ধাপ নির্ণয় করা হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই ধাপ নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসা
কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য প্রাথমিকভাবে একজন অভিজ্ঞ অনকোলজিস্ট (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ) এর সাথে পরামর্শ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ক্যান্সারের স্তর ও শারীরিক অবস্থা দেখে চিকিৎসার পরিকল্পনা তৈরি করবেন।
ঝুঁকি এড়াবেন কীভাবে
স্বাস্থ্যকর খাবার, নিয়মিত শরীরচর্চা, মদ্যপান ও ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। লাল মাংস খাওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সঠিক সময় অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী কোনও রোগ থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে। এসব মূল শারীরিক নিয়মনীতি মেনে চললেই এই অসুখের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন এই গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে লাল চালের ভাত।
এ ছাড়া প্রতিদিনের খাবারে পর্যাপ্ত টাটকা ফলমূল, শাক-সবজি, ভূষিসহ আটার রুটি, ওট্স, শস্যদানা রাখতে হবে। এচ ছাড়া হলুদে কারকিউমিন নামক যৌগ রয়েছে যা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টি-ক্যান্সার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। আমলকী ও অন্যান্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাওয়ার আগেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। ফাইবারযুক্ত লাল/ব্রাউন চালের ভাতও রোধ করতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্য।
কোন খাবার কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়
দেশীয় কিছু খাবার আছে যা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এই খাবারের তালিকায় পান্তা ভাত রয়েছে। কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পান্তা ভাত কিভাবে কাজ করে এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ডিয়ার ডায়েট এর প্রাণ-রসায়নবিদ ও হেলথ কনসালটেন্ট কানিজ ফাতেমা ছন্দা।
তিনি জানান, আমাদের কোলনে বিফিডোব্যাকটেরিয়া নামে এক ধরনের প্রজাতি থাকে। কোলন ক্যান্সারের গবেষণায় দেখা গেছে, এরা কোলনে অ্যান্টি-টিউমারের প্রভাব তৈরি করতে পারে। কোলনে এদের সংখ্যা কমে গেলে রোগির ক্যান্সার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
আর বিফিডোব্যাকটেরিয়া সহজে পাওয়া যায় ফার্মেন্টেড খাবারে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গবেষণা যে খাবার নিয়ে করা হয়েছে, সেটা হলো দই। যারা সপ্তাহে অন্তত দুইবার নিয়মিত দই খান, তাদের এই ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে আসে।
অন্যদিকে ভাত ঠিকমতো ফার্মেন্ট (গাঁজন প্রক্রিয়া) করলে পান্তা ভাতেও এই বিফিডোব্যাকটেরিয়া বেড়ে যায়। দই আমাদের দেশীয় খাবার হলেও পান্তা ভাত একদম গ্রাম বাংলার আদি খাবার। পঁচা, অ্যালকোহল, বাসি বলে পান্তা না খাওয়ার বা শুধু পানি ঢেলে পান্তা খাওয়ার কোন উপকারিতা নেই। এক্ষেত্রে সঠিক নিয়মে পান্তা ভাত তৈরি করে খেতে হবে।
তরুণদের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ক্রমবর্ধমান হার একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, বিশেষ করে খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে এই ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং নিয়মিত স্ক্রিনিং করানো জরুরি। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পাশাপাশি দেশীয় ও প্রাকৃতিক খাবারের ব্যবহার কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।