Home বিনোদন ‘রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ— এ পরিচয়েই আমার গর্ব’

‘রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ— এ পরিচয়েই আমার গর্ব’

ফারজানা জামান
১৬৩ views

রুনা লায়লা, উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি তো অদ্বিতীয় বটেই, উপমহাদেশের শ্রোতা ভক্তদের কাছেও তিনি সুরেলা এক উপাখ্যান। ১৭ নভেম্বর ছিল কিংবদন্তি এই শিল্পীর বাহাত্তর তম জন্মদিন। আর সেই উপলক্ষ্যেই তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন হ্যালো বাংলাদেশের।

নাতিদীর্ঘ এই আলাপচারিতায় রুনা লায়লা হ্যালো বাংলাদেশকে জানালেন তার জীবনের বিভিন্ন বাঁকের গল্প। সেই গল্প কখনো চলে গেছে ভারতের মোহাম্মদ রফির সাথে গান করার ডুয়েটে, কখনো চলে গেছে পাকিস্তানের প্লেব্যাক করার ব্যস্ততার সময়ে। আবার ঠিকই ফিরে এসেছে বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল ঘাটে। যে ঘাসের সাথে তার নিত্য দিনের আলাপ, যে শিশিরের সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক।

আলাপের প্রথমেই আসে মোহাম্মদ রফির কথা। রুনা লায়লা মানেই শুধু দমাদম মাস্ত কালান্দার নয়। বরং অগ্নিপথ সিনেমার নাচের গান আলীবাবা, ঘর দিওয়ার সিনেমার ও মেরা বাবু ছেইল ছাবিলা, চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনাসহ একাধিক গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। বাপ্পি লাহিড়ীর সাথে ছিল তার দারুণ রসায়ন। এজন্য বাপ্পি লাহিড়ীর সাথে কাজ হয়েছে একটু বেশি। রুনা লায়লা জানান, কাজের কারণে তাকে প্রায়ই উড়ে যেতে হতো আজকের মুম্বাইয়ে, আগের বোম্বাই।

আর তখনই তার প্রিয় গায়ক মোহাম্মাদ রফির সাথে তার দেখা। রুনা লায়লা জানান, মোহাম্মদ রফি তার প্রিয় গায়ক ছিলেন। গায়িকার ভাষায়, আমি ছিলাম দিলীপ কুমারের ভক্ত। আর রফি সাহেবের কণ্ঠ শুনলে আমার চোখে দিলীপ সাহেবের চেহারা ভেসে উঠতো। স্বপ্নের নায়কের মাধ্যমেই স্বপ্নের কণ্ঠ হয়ে ওঠেন রফি সাহেব আমার কাছে।

এরপর একদিন আসলেই স্বপ্নের কণ্ঠের মুখোমুখি হন এই শিল্পী। স্টুডিওতে একটি রেকোর্ডিংয়ের জন্য গিয়ে দেখেন লতা মুঙ্গেশকর এবং মোহাম্মাদ রফি উপস্থিত। রফি সাহেব বসে আছেন। রুনা লায়লা জানান, রফি সাহেব আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে যান। আমি তো একদম হকচকিয়ে গেলাম। কি করে সম্ভব! এত বড় শিল্পী আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন রফি সাহেব বলেন, আপনি আমাকে দেখতে এত দূর থেকে এসেছেন, আপনাকে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানো আমার দায়িত্ব।

নিজের এই অভিজ্ঞতা জানিয়ে রুনা লায়লা হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, শিল্পীর এই বিনয় না থাকলে যতই মেধা থাকুক তার, ঠিক যেন শিল্পী হয়ে ওঠেন না। আমার আগের শিল্পীদের কাছ থেকে আমি প্রকৃত শিল্পী হওয়ার তালিম নিয়েছি।

সদা মৃদুভাষী রুনা লায়লা তার সীমানার বাইরের সম্পর্কের কথা জানাতে গিয়ে আরও বলেন, এই সময়েরও অনেক শিল্পীর সাথে তার আন্তরিকতার সম্পর্ক আছে। হেসে জানালেন, বাহাত্তরতম জন্মদিনেও সনু নিগাম তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে। সনু নিগাম এবং শ্রেয়া ঘোষালের প্রসঙ্গ আসতেই হ্যালো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় অটো টিউন নিয়ে। ভারতে বিশেষ করে এখন অটো টিউন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শিল্পীরা। তাদের মাঝে শ্রেয়া ও সনু অন্যতম।

রুনা লায়লা এ প্রসঙ্গে বলেন, অটো টিউন তো ভালো লাগার কিছু নেই। যে অটো টিউন দিয়ে গান করে, তিনি কী আসলে শিল্পী?

পাল্টা প্রশ্ন করে নিজেই স্মিতভাবে হাসলেন। এই হাসি প্রকৃতপক্ষে সব উত্তর দিয়ে দেয়। পরে অবশ্য নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রুনা বলেন, আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করেছি। এই যে আমরা কথায় কথায় লতাজি, আশা ভোঁশলের উদাহরণ দেই, তারা সকলেই রেওয়াজের মানুষ। দিনের পর কষ্ট করে আমরা কণ্ঠ তৈরি করেছি যেন শ্রোতারা শুনে স্বস্তি পায়।

প্লেব্যাকের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি যোগ করেন, আগে তো আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিউজিশিয়ানদের সাথে রিহার্সেল করতাম। সবাই মিয়ে একসাথে সুর, গানের কথা, বাচনের ভঙ্গি নিয়ে আলাপ করতাম, তারপর টেক করতাম। এমনও হয়েছে একশ বারও টেক দিতে হয়েছে একটি নির্ভুল গান তৈরির জন্য।

‘রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ— এ পরিচয়েই আমার গর্ব’

এই সময়েরও অনেক শিল্পীর সাথে আন্তরিকতার সম্পর্ক আছে শিল্পী রুনা লায়লার, ছবি: হ্যালো বাংলাদেশ

বর্তমানের অবস্থা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এখন তো কারও সাথে কারও দেখা হয় না। যে যার মতো এসে কণ্ঠ দিয়ে যায়। যুগের পরিবর্তনের হাওয়াতে ট্র্যাক চলে আসে আগে। যে যার অংশ ট্র্যাকে গেয়ে নেয়।

তার নিজের কাজের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, আমার গানের ক্ষেত্রে আমি আগে ট্র্যাক ও সম্পূর্ণ গানের কথা আগে চেয়ে পাঠাই। আমাকে দিলে নিজে নিজে রিহার্সেল করি এবং স্টুডিওতে এসে পরে কণ্ঠ দিয়ে যাই।

যুগের হাওয়ার স্রোতে নতুনদের মাঝেও একইভাবে দাপটের সাথে গাইতে থাকা শিল্পীর চোখে নতুনরা কেমন— হ্যালো বাংলাদেশের এই প্রশ্নে শিল্পী জানান, কারো গান ভালো লাগলে, ঐ শিল্পী যদি আমার পরিচিত হয়, আমি সাথে সাথে জানাই গানটা ভালো হয়েছে। কখনও মেসেজ করি। আবার কখনো নিজে থেকে পরামর্শ দেই যে এই জায়গাটা এভাবে গাইলে ভালো হতো।

কাকে কাকে তার ভালো লাগে— সে প্রসঙ্গে রুনা লায়লা জানান, চ্যানেল আই আয়োজিত সেরা কণ্ঠের যে তিন সিজনের তিনি বিচারক ছিলেন, সেই তিন সিজনেই ভালো শিল্পী উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে কোনাল, ঝিলিক, ইউসুফ, ইমরানের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা সকলেই ভালো গাইছে, সুর করছে, ভালো কাজ করছে।

নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখন আসলে সবারই সময় অনেক কম। হয়তো অতটা আয়োজন করে বসা যায় না। সেক্ষেত্রে যেকোনো অবস্থায় বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও কিন্তু গানটা চর্চা করা যায়। আমি আমার প্রিয় শিল্পীর যেকোনো গান গেয়ে চর্চা করি এখনও। যে গানটা শুনলে আমার ভালো লাগে, সেটাই একা একা গেয়ে দেখি কেমন লাগছে।

এভাবেই তার রেওয়াজ নিত্যদিনের সাথী। পাশাপাশি নিয়মিত গানও করে যাচ্ছেন। কখনো মঞ্চে– কখনো নায়িকার পেছনে আবার কখনো মনের আনন্দে। ১৯৭৪ সালে তিনি যখন বাংলাদেশে চলে আসেন পাকিস্তান থেকে- তখনও নিজের ভাষায় বাংলা গান করার আনন্দেই চলে আসেন। তিনি বলেন, সেই সময়ে ছয়টা প্লেব্যাক হলেও পাঁচটার রেকোর্ডিং আমিই হয়েতো করতাম। তবুও আমি বাংলাদেশে চলে আসি, কারণ এটি আমার দেশ।

আলাপের একদম শেষ পর্যায়ে এসে রুনা লায়লা বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আমি গর্ববোধ করি। বিদেশের মাটিতেও যখন আমাকে নানা বিশেষণ দেয়, আমি বলি, প্লিজ আমাকে পরিচয় করিয়ে দাও, রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ- হিসেবে। এই পরিচয়টাই আমার কাছে মুখ্য। আমি কখনোই তাই ভাবিনি অন্য কোথাও চলে যাবার। এমনকী ওই জৌলুস ছেড়ে এ কারণেই পাকিস্তান থেকে চলে আসি আমি।

‘রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ’ তাই এখনও বাংলাদেশের এমন নক্ষত্র যাকে সারা বিশ্বের মানুষ দূর থেকে দেখতে পায়। তাই রুনা দাবি করেন, মিডিয়া যেন ইতিবাচকতার সাথে শিল্পীর অর্জনকে সামনে তুলে ধরেন।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ