Home বিনোদন শবনম: এক রাজকন্যার গল্প

শবনম: এক রাজকন্যার গল্প

ফারজানা জামান
১৩৫ views
পুলিশ তখন শবনমের সম্ভ্রমহানির মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়

‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা, রূপের জাদু এনেছি’ গানটা বাজলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক রাজকন্যার ছবি। যে রাজকন্যা একচ্ছত্রভাবে রাজত্ব করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের রুপালি পর্দায়। কিন্তু তার সেই জীবন কি আদৌ রাজকন্যার মতো ছিল? নাকি রূপকথার মতো তার জীবনেও ছিল কোনো দুষ্টু সেনাপতির আক্রমণ? এই গল্প শবনমের।

ভারতীয় উপমাহাদেশের অভিনেত্রী শবনম, যার ঝুলিতে রয়েছে উর্দু, বাংলা ও পাঞ্জাবি ভাষায় নির্মিত ১৮০টি ছবি করার দুর্লভ ইতিহাস। তিনি অর্জন করেছেন ১৩টি  নিগার পুরস্কার, যেটি খুব সামান্য বিষয় নয়। সর্বশেষ তাকে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের লাক্স স্টাইল অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে দেখা যায় আজীবন সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করার সময়।

শবনমের প্রকৃত নাম ঝর্ণা বসাক। জন্ম ১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায়। যে রুপালি জগতের জন্যে তিনি ঝর্ণা থেকে শবনম হয়েছিলেন, সেই রুপালি জগৎই  তার ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ে আসে চরম বিপর্যয়।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই বাংলাদেশি সিনেমায় ‘আম্মাজান’-খ্যাত অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনার।

দিনটা ১৯৭৮ সালের ১৩ মে। স্থান পাকিস্তানের লাহোরের অভিজাত এলাকা গুলবার্গ। পাকিস্তানের সমকালীন পত্র-পত্রিকার বরাতে জানা যায়, সেদিন ৭ জন বন্দুকধারী অভিনেত্রী শবনমের বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে এবং স্বামী রবিন ঘোষ ও একমাত্র সন্তান রনি ঘোষের উপস্থিতিতে শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছনা করে।

পাকিস্তানে এখনও বলাবলি করা হয়, আসামিরা শবনমকে তার পেশার জন্যই নিজেদের শিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তখনকার পাকিস্তানের ক্রাইম রিপোর্টার জামীল চিশতীর মতে, তখন ‘মার্শাল ল’র সময় ছিল। আসামিরা এতটাই নির্ভীক ছিল যে তারা এর পরিণামের কথা ভেবেও দেখেনি। তার ভাষ্যমতে, অভিজুক্ত আসামিদের প্রভাবে তখন স্থানীয় পুলিশ এই ঘটনায় শুধু চুরি ও লুটপাটের মামলা করে। পুলিশ তখন শবনমের সম্ভ্রমহানির মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

অভিযুক্ত আসামিরা ছিলেন— ফারুক বান্দায়াল, ওয়াসিম ইয়াকুব ভাট, জামিল আহমেদ, তাহির তানভীর, জামশেদ আকবর সাহি, আঘা আকীল আহমেদ, মোহাম্মেদ মুযাফফার। আসামিরা সবাই প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান ছিলেন। স্পেশাল মিলিটারি কোর্টে বিচার বসে। অভিযুক্তদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড তখনকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হক নিজে নির্ধারণ করেছিলেন। পরে পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী এস এম জাফরের রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হককে লেখা চিঠির বদৌলতে তাদের ক্ষমা করে দেওয়া  হয়।

পাকিস্তানের বিভিন্ন সাংবাদ মাধ্যমের মতে, ঘটনার পর থেকেই অভিনেত্রী শবনম তার একমাত্র ছেলে রনি ঘোষের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন। তিনি প্রথমে তার সন্তানের সুরক্ষার জন্য অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী রাখলেও পরে তার সন্তানকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সবাই প্রভাবশালী পরিবারের হওয়ায় তিনি বিভিন্ন সময় মামলা থেকে সরে আসার হুমকি পেতেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা মুক্তি পাওয়ার পর তার নিজের সন্তানের জন্য ভীতি আরও বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ সালে তিনি সাংবাদিক শাহেদ নাসের চৌধুরীর সাথে শাহনূর স্টুডিওতে তার শেষ উর্দু ছবি ‘আউলাদ কি কসম’ এর শুটিংয়ের সময় তাকে বলেন, ‘আমি নিজের একমাত্র সন্তানের সুরক্ষার কথা সবসময় চিন্তা করি। আমার পক্ষে এই ভয়ে এই দেশে থাকাটা আর সম্ভব নয়।’

এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। অভিনয় করেন তার জীবনের শেষ ছবিতে, যার নাম ‘আম্মাজান’। যেই মাতৃত্বের জন্য তিনি তার কষ্টে গড়া অভিনয় জীবন ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন সেই মাতৃত্বের ওপর নির্ভর করে নির্মিত ‘আম্মাজান’ই তাকে বাংলা সিনেমায় অমর করে রেখেছে।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুন