বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত ১৭তম বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবের পর্দা নামলো গত শুক্রবার। নানা প্রতিকূলতা ও নেতিবাচক প্রচারণার পরেও এই আয়োজন সফল হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে আয়োজক কমিটি। একই ধরনের মন্তব্য করেন সমাপনীআয়োজনে উপস্থিত প্রধান অতিথি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
উৎসবকে কেন্দ্র করে সংবাদ পাড়া ও নেট দুনিয়াতে আলোচিত অনেক প্রশ্নের উত্তর দেন ফারুকী নিজেই। বিশেষ করে তিনজন জ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতার অভিযোগ ও শর্ট ফিল্ম ফোরাম বিভক্ত হওয়া নিয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর দেন তিনি।
ফারুকী বলেন, আমার বিরুদ্ধে প্রথম যে অভিযোগ- আমি শর্ট ফিল্ম ফোরামকে দুই ভাগ করেছি, তা একেবারেই সত্য নয়। কারণ এই ফোরামের যদি কোনো সিদ্ধান্ত হয়, তা নেবে বা নিয়েছে ফোরামের সদস্য। আমি কখনোই ফোরামের সদস্য ছিলাম না।
শর্টফিল্ম ফোরাম আয়োজিত ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে প্রথম থেকেই সংশয় তৈরি হয়। বিশেষ করে তিন পরিচালক- তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম ও মানজারে হাসিন মুরাদ এর বিপরীতে অবস্থান নেন বলে জানান ফোরামের সদস্য ও উৎসব উদ্যোক্তারা। তারা উৎসব না হওয়ার পক্ষে নিজস্ব যুক্তি সামনে রাখেন, ফলে ফোরামে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এরপর উৎসব পরিচালক সৈয়দ ইমরান হোসেন কিরমানি ও ডা. জহিরুল ইসলাম কচির নেতৃত্বে আয়োজনটি আলোর মুখ দেখতে পায়। এসবের মাঝেই বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে উৎসবের বিপরীতে থাকা তিন পরিচালকের পক্ষ থেকে ফারুকীকে দোষারোপ করা হয়।
পরিচালক ফারুকী কিছুটা খেদ নিয়েই বলেন, আমি ফোরামের সদস্য ছিলাম না বটে, কিন্তু আজিজ সুপার মার্কেটের আড্ডায়, শাহবাগের আইডিয়া বিনিময়ের স্থানে তাদের সাথেই বড় হয়েছি। তাদের এই অভিযোগ শুনে আমি ব্যথিত হয়েছি। পাশাপাশি এও প্রশ্ন করতে চাই, এর মাধ্যমে কি তারা ফোরামের তরুণদের নিরুৎসাহিত করলেন না?
মূলত এই উৎসবের শুরুতেই জুলাই বিপ্লবকে উৎসর্গ করা নিয়ে নাম না জানাতে উপস্থিত এক পরিচালক হ্যালো বাংলাদেশকে জানান। সেই সুত্র ধরেই ফারুকী উল্লেখ করেন, এমন তো হতে পারে না যে কারো পছন্দের সরকার নেই বলে একটি উৎসব হবে না, তাতো হতে পারে না!
২০২৪ সালে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও শিল্পী সমাজ নিয়ে ফারুকী আরও বলেন, একজন শিল্পীর কাজ সময়কে পাঠ করা। আর সিনিয়র যারা আছেন তারা সেই সময়কে পড়তে পারেননি- এ আমি বিশ্বাস করি না। বরং আমি মনে করি, তাদের মনে হয়তো কোথাও না কোথাও পক্ষপাতিত্ব আছে। ফলে তারা সময় ও যুগ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট পাঠ করেও নিজেকে পাঠক হিসেবে প্রকাশ করতে পারছেন না।
নিজেদের সময়কে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা যখন বড় হয়েছি তখন আমরা জানতাম কার কোন রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে। তারপরও একসাথেই আমরা বড় হয়েছি। তখন তো আমরা জেনেও কাউকে হেয় বা কাউকে ত্যাগ করিনি। আমরা সবাই বন্ধু ছিলাম, পাশাপাশি ছিলাম। কিন্তু গেল সরকারের আমলে এই পাশাপাশি অবস্থান করাকে নিরৎসাহিত করে মুখোমুখি অবস্থানের দিকে টেনে নিয়ে গেছে ফ্যাসিস্টরা।
তিনি দাবি করেন, তাতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি বিশ্বাসের সাম্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি দেশ ছাড়তে হয়েছে আমাদের অনেকের।
বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ফারুকীর কর্মজীবন ফিকশন নির্মাতা বলেই তিনি বারবার তার ‘বড় ভাই’দের কথা উল্লেখ করেন, যারা নিজেরাও নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, চব্বিশে যখন পাখির মতো মানুষ মারা হলো, তখন কী করে আমার বড় ভাইরা চুপ থাকলো! পত্রিকায় মেয়েদের রক্তাক্ত ছবি ছাপা হলো, এরপরও কিভাবে তারা পথে নামলো না?
এরপর ফারুকী ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে বলেন, জনগণ বারবারই ফুঁসেছে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট প্রধানের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে পারেনি। কখনও শাহজাহান খানকে নিয়ে বলেছে, কখনও অন্য কোনো নেতা। কিন্তু চব্বিশে এসে জনগণ বুঝে গেছে, এখন নয় তো কখনও নয়। তবে আমার বড় ভাইরা কথা বলবে আমি ভেবেছিলাম, কিন্তু বলেননি। এখানেই প্রজন্মের পার্থক্য, বলেন ফারুকী।
আলাপের শেষে তিনি বলেন, আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাইরা রাষ্ট্রীয় লুটপাটে, অরাজকতায় চুপ থেকে প্রমাণ করেছেন যে তাদের সাথে ইতিহাসের কোনো যোগযোগ নেই।
উল্লেখ্য মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বর্তমানের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আসনে থাকলেও সিনেমা বানানোর জাহাজের নাবিকের ভূমিকা থেকে অব্যাহতি নেননি। সম্প্রতি তার পরিচালিত সিনেমা ৮৪০ মুক্তি পেয়েছে প্রেক্ষাগৃহে।