দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে অবৈধ, নকল ও নিম্মমানের ডায়মন্ড বা হীরা। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে ক্রেতারাও শিকার হচ্ছেন প্রতারণার। নকল নিম্মমানের ও অবৈধ ডায়মন্ডের দৌরাত্ম্য বন্ধে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) উদ্যোগ নিলেও তাতে ফল মিলছে না। এসব হীরার গয়না বিক্রি হচ্ছে দেদারছে।
গত কয়েক বছর ধরে দেশে হীরা আমদানি কমে মাত্র লাখ টাকার ঘরে নেমেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি কমলেও বছরে এখন গড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার হীরার গয়না বিক্রি হচ্ছে দেশে। দেশে হীরার খনি নেই। উৎপাদনও হয় না। আমদানি ছাড়া এই রত্নের বেচাকেনা ছয় হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ায় হীরার বাজার ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। হীরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপে দুটো বিষয় পাওয়া গেছে। প্রথমত, স্বর্ণের মতো শুল্ক ফাঁকি দিতে চোরাই পথে ভারত থেকে হীরা আসছে। দ্বিতীয়ত, আবার আসল হীরার নামে বিক্রেতারা ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছেন পরীক্ষাগারে তৈরি নকল হীরা। হীরার মতো দেখতে মোজানাইট কিংবা জারকান পাথরও বিক্রি হচ্ছে আসল হীরার নামেই।
আমদানি না হলেও হীরার বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে দেশে। ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডায়মন্ডের গয়না বিক্রির শতাধিক দোকান রয়েছে। এর বাইরে স্বর্ণের দোকানেও হীরার গয়না বিক্রি হয়। এসব দোকানে বছরে কত বেচাকেনা হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশের হীরার বাজার নিয়ে সমীক্ষা করেছে এই ব্যবসায় যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের হিসাবে, হীরার গয়না বেচাকেনা হয় বছরে তিন থেকে সাত হাজার কোটি টাকার। গড় বাজার হিসাব করা হলে বছরে তা প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার।

ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে হীরা আমদানির সুযোগ নেই। তাহলে দেশের বাজারে বেচাকেনা হওয়া এত হীরা কীভাবে ও কোথায় থেকে আসছে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় হীরা আমদানির পুরোনো তথ্যে। গত ১৯ বছরে যত হীরা আমদানি হয়েছে, তার ৮৭ শতাংশই আনা হয়েছে ভারত থেকে। ভারতের গুজরাটের সুরাটে বিশ্বের ৬৫ শতাংশের বেশি হীরা কাটিং ও পলিশিং করা হয়। খুব সহজে বহন করা যায় বলে দেশটি থেকে অবৈধভাবে হীরা আসছে বলে ব্যবসায়ীদের ধারণা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় কয়েক বছরে কয়েকটি চালান জব্দ করেছেন। ২০২১ সালে সাতক্ষীরা সীমান্তে পৌনে দুই কোটি টাকার ১৪৪টি হীরার গয়না জব্দ করে বিজিবি। ২০১৮ সালে ৭০ লাখ টাকার হীরার গয়না জব্দ করা হয়।
অবৈধ পথে হীরা আমদানির বড় কারণ শুল্ক ফাঁকি। হীরা আমদানিতে শুল্ক–কর বেশি। যেমন বন্ড সুবিধা ছাড়া অমসৃণ হীরা আমদানিতে করভার ৮৯ শতাংশ। মসৃণ হীরা আমদানিতে করভার প্রায় ১৫১ শতাংশ। এই শুল্ক–কর ফাঁকি দিতেই মূলত হীরা অবৈধ পথে আনা হচ্ছে। গত ১৯ বছরে এই মূল্যবান রত্ন আমদানিতে সরকার মাত্র ১২ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে।
হীরার বাজারে আরেকটি রহস্যজনক আচরণ হলো দেশের বাজারে দাম। দেশের বাজারে এক ক্যারেট (০.২ গ্রাম) হীরার দাম ৭৯ হাজার টাকা। আর সবচেয়ে কম অর্থাৎ শূন্য দশমিক ১০ ক্যারেট হীরার দাম ৭ হাজার ৯১৪ টাকা। বাংলাদেশে নাকফুলসহ হীরার অলংকার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকার নিচে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, হীরার ক্ষুদ্র টুকরো ব্যবহার করা হলেও এত কম দামে হীরার গয়না পাওয়ার কথা নয়। এগুলো আসলে উন্নতমানের কাচের টুকরা।
আমদানি না হলেও বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ডায়মন্ডের গহনা বিক্রি হচ্ছে দেশে। তারা আরও বলছেন, একশ গ্রাম পর্যন্ত গহনা আনার সুযোগ নিয়ে ডায়মন্ডের ব্যবসায়ীরা আরও বেশি ওজনের ডায়মন্ডের গহনা নিয়ে আসছে ভারত ও দুবাই থেকে। যদিও ৯০ শতাংশের বেশি ডায়মন্ডের গহনা ভারত থেকে আসছে চোরাই পথে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের উচিত এসব কীভাবে আমদানি হচ্ছে, তার কাগজপত্র চেক করা। তাহলেই তো বেরিয়ে আসবে আসল রহস্য।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক হীরা শনাক্তকারী ল্যাব রয়েছে। এটির নাম হচ্ছে সলিটায়ার জ্যামোলজিক্যাল ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড (এসজিএল)। বিক্রেতা এবং ক্রেতা দুই পক্ষই এই ল্যাবে আসল হীরা পরীক্ষা করছে। পরীক্ষায় হীরায় আসল-নকলের হার কেমন জানতে চাইলে এসজিএল বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাহাদ কামাল বলেন, আসল হীরা যেমন পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি নকল হীরাও মিলছে পরীক্ষায়। হীরার নামে মোজানাইট, জারকানের মতো পাথরও পাওয়া গেছে। নকল ঠেকাতে আসল হীরার গায়ে সনদ নম্বর তারা খোদাই করে দিচ্ছেন, যাতে যেকোনো জায়গায় ক্রেতারা চাইলে বিক্রি করতে পারেন।
তিনি বলেন, বছরে বাংলাদেশে তিন থেকে সাত হাজার কোটি টাকার হীরার গয়না বেচাকেনা হয়। গত কয়েক বছরে হীরার গয়নার বাজার বড় হচ্ছে। সমীক্ষায় এমন চিত্র পাওয়ার পর এই পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে।
হীরার দাম চারটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সেগুলো হলো হীরার ওজন বা কত ক্যারেট, স্বচ্ছতা, রং এবং কীভাবে কাটা হয়েছে তার ওপর। কোনো হীরায় এই চারটি বিষয়ের মান কেমন, তা জানতে সনদের দরকার হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ স্বর্ণ ও ডায়মন্ড বৈধর জন্য ২০১৯ সালের জুনে যৌথভাবে মেলা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। সে সময় ডায়মন্ড বৈধ করে একশ’র কম প্রতিষ্ঠান। অথচ বর্তমানে ঢাকা শহরেই পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে ডায়মন্ডের পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
তারা বলছেন, ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি জুয়েলারির দোকানে ডায়মন্ডের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান কোথায় ডায়মন্ড পাচ্ছে? কারণ স্বর্ণের মতো ব্যাগেজ রুলে আসার কোনো সুযোগ নেই ডায়মন্ডের। অন্যদিকে ডায়মন্ড বৈধ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। সুতরাং সরকারের উচিত জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলো বৈধ ও আসল ডায়মন্ড বিক্রি করেছে কি-না তা খতিয়ে দেখা।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, বাজারে একদিকে যেমন অবৈধ ডায়মন্ড রয়েছে, তেমনি রয়েছে নকল ডায়মন্ড। নকল ডায়মন্ডের মধ্যে রয়েছে- ‘মেসোনাইড’, ‘সিভিডি’, ‘ল্যাব মেইড/ম্যান মেইড’ এবং ‘এডি’ পাথর। সাধারণ চোখে দেখে ক্রেতাদের পক্ষে এসব নকল ডায়মন্ড চেনা সম্ভব নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলো আসল বলে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।
নকল ও অবৈধ ডায়মন্ডের দৌরাত্ম্য বন্ধে বাজুস একটি নীতিমালা করেছে। বাজুস কর্মকর্তারা জানান, আমরা চাই ক্রেতারা যেন প্রতারিত না হন। ক্রেতাদের সর্বোত্তম সেবা দেয়ায় আমাদের লক্ষ্য। এ জন্য মেসোনাইড, সিভিডি, ল্যাব মেইড/ম্যান মেইড এবং এডি আমরা বাজার থেকে অপসারণ করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ১ থেকে ৫০ সেন্টের মধ্যে সব ডায়মন্ডের গহনার কালার ও ক্লিয়ারিটির সর্বনিম্ন মানদণ্ড হবে ‘আইজে’ এবং ‘এসআই টু’। ৫০ সেন্টের ওপর সব ডায়মন্ডের গহনার ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
একাধিক জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, অবৈধ ও নকল ডায়মন্ডের একটি বড় অংশ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান ছাড় দিয়ে বিক্রি করেন। কম দামে ডায়মন্ডের পণ্য পাচ্ছেন, এমন ভেবে অনেক সময় ক্রেতারা প্রতারিত হন। কারণ বাজারে যেসব নকল ডায়মন্ড বিক্রি হয় তা হুবহু আসল ডায়মন্ডের মতো দেখতে। ফলে ছোট ক্রেতারা আসল নাকি নকল ডায়মন্ড কিনছেন তা বুঝতে পারেন না।
ভেনাস জুয়েলার্সের কর্ণধার ও বাজুসের সাবেক সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, আমাদের বাজারে নকল ডায়মন্ড বলে কিছু নেই। তবে ডায়মন্ডের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কম টাকায় তো ভালো মানের ডায়মন্ড পাওয়া যাবে না। মেসোনাইড, সিভিডি, এডি ডায়মন্ড না। আমরা ক্রেতাদের কাছে এগুলো তথ্য গোপন করে বিক্রি করি না।
ব্যাগেজ রুলে তো দেশে ডায়মন্ড আসে না। তাহলে এতো ডায়মন্ড কোথা থেকে আসছে— এমন প্রশ্ন করা হলে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাগেজ রুলে ডায়মন্ড আসার সুযোগ নেই। সরকারকে যথাযথভাবে শুল্ক দিয়েই বাইরে থেকে ডায়মন্ড আনতে হবে। এখন প্রায় প্রতিটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে ডায়মন্ড বিক্রি হচ্ছে। এতো ডায়মন্ড কোথা থেকে আসছে তা আমি বলতে পারবো না। এসব ডায়মন্ডের বৈধতা সরকারের দেখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় ক্রেতারা কম দামে ডায়মন্ডের পণ্য কিনতে চান। আমি তাদের পরামর্শ দিই, ১০ হাজার টাকা দিয়ে ডায়মন্ডের পণ্য না কিনে স্বর্ণ কেনা উচিত। ১০ হাজার টাকা দিয়ে তো ভালো ডায়মন্ড পাওয়া সম্ভব নয়। এর থেকে এডি পাথর ভালো। কারণ এডি পাথর ডায়মন্ডের মতোই ঝকঝকে। এছাড়া ছাড় দিয়ে যারা ডায়মন্ডের পণ্য বিক্রি করেন, তারা বাড়তি দাম ধরেই ছাড় দেন। সুতরাং ক্রেতারা ছাড় পাচ্ছেন— এমন ধারণা করে ডায়মন্ডের পণ্য কিনলে ঠকবেন।