Home বাণিজ্য বাংলাদেশে চীনা ঋণ পরিশোধের চাপ আসন্ন

বাংলাদেশে চীনা ঋণ পরিশোধের চাপ আসন্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৩৪ views

বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে যেসব বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে দেখা গেছে সেগুলোর বেশিরভাগের সঙ্গে চীন গভীরভাবে যুক্ত। দেশে ছোট-বড় ও মাঝারি মিলিয়ে চীনের অর্থায়নে অন্তত ২৭টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এরমধ্যে বৃহৎ প্রকল্প রয়েছে ৯টি, যেগুলোতে দেশটির বিনিয়োগের পরিমাণ ৮.৮০ বিলিয়ন বা ৮৮০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। এ অর্থায়নের বেশিরভাগই ঋণ হিসেবে দিয়েছে দেশটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা বিনিয়োগের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শেষে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বাংলাদেশ বেশ চাপে পড়বে। আগামী চার বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধের বোঝা বেড়ে যাবে অনেক গুণ।

সূত্র জানায়, চীনা ঋণ প্রকল্পের সুদের হার ২ শতাংশের মতো, যা অপরাপর ঋণ প্রকল্পের মতোই কিংবা কিছু ক্ষেত্রে কিছু কম। কিন্তু চীনের প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে হয় না বলে প্রকল্পের খরচ অনেক বেশি হয়। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), জাইকা, বিশ্বব্যাংকের ঋণের মতোই চীনা প্রকল্পে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকে। তবে চীনের ঋণ আনুমানিক ১৫ বছরে পরিশোধ করার শর্ত থাকে, যেখানে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান ঋণ পরিশোধে ৩০ বছর পর্যন্ত সময় দেয়। অর্থাৎ চীনের ঋণ দ্রুত পরিশোধ করতে হয়, তাই কিস্তি প্রতি জমার পরিমাণ বেশি।

প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ, ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঠিকাদারি কাজ ও বছরে ১৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি নিয়ে বাংলাদেশে চীন তার পদচ্ছাপ (ফুটপ্রিন্ট) সুগভীর করে ফেলেছে।  বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী একক দেশ হিসেবে চীন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে জাপান। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

পদ্মা সেতু 1
পদ্মা সেতু । ছবি : সংগৃহীত

২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের ২৭টি প্রকল্পের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে ৮.৮ বিলিয়ন ডলারের ৯টি বড় প্রকল্পের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। প্রকল্পগুলোর অধীনে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার।

চীনা অর্থায়নের  প্রকল্পগুলোর কোনোটার বাস্তবায়ন শেষ, কোনোটার কাজ এখনো চলছে। তেমন কিছু প্রকল্প হলো, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল (ঢাকা-মাওয়া-যশোর), কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, দাসেরকান্দি পয়োবর্জ্য শোধনকেন্দ্র। এ ছাড়া আরও আছে ফোর টায়ার ডেটা সেন্টার, শাহজালাল সার কারখানা, পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্প, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও ডিজিটাল সরকার প্রকল্প, মোবাইল অপারেটরের একচেটিয়া নেটওয়ার্ক ভেন্ডর, গোয়েন্দা সংস্থার আড়ি পাতা বা সিটিজেন সার্ভেইলেন্সে এনটিএমসির ইন্টিগ্রেটেড এলআইসি (লফুল ইন্টারসেপ্ট), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নজরদারি সফটওয়্যার, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র।

পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন, ঢাকা-মাওয়া-যশোর রেললাইন—এমন কিছু প্রকল্পকে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্প হিসেবে দাবি করে।   এর বাইরে তাদের পরিকল্পিত অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প ১১টি। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জন্য চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনা, তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশন পর্যন্ত রেললাইনকে মিটারগেজ থেকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর, ডিজিটাল কানেকটিভিটি স্থাপন ও পৌরসভাগুলোর জন্য পানি সরবরাহ প্রকল্প। এই ১১ প্রকল্পে চীন থেকে ৫০২ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলোর কাজ এখনো শুরু হয়নি।

চীনা ঋণে নেওয়া বৃহৎ ৯ প্রকল্পের মধ্যে সব শেষ প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে শেষ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন খাতে ঋণ ও অনুদান হিসেবে মোট ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। যার মধ্যে প্রায় ৬৯৪ কোটি ডলার ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে। অনুদান হিসেবে এসেছে খুব সামান্য। সিংহ ভাগই ঋণ। এসব ঋণের বেশির ভাগই এসেছে গত দুই দশকে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বেসরকারি উদ্যোগে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৪৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৭৬ কোটি ডলারের ঋণ অর্থায়ন হয়েছে চীনা উৎস থেকে। অর্থায়ন করছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্যাংক অব চায়না ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক। 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ছাড়াও সড়ক যোগাযোগ, রেলওয়ে ও সেতু নির্মাণ খাতের বড় প্রকল্পগুলোয়ও বিপুল পরিমাণ চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। এরই একটি পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প।  ইআরডি জানিয়েছে, প্রকল্পটিতে চীনা ঋণ প্রায় ২৬৭ কোটি ডলার। এ প্রকল্পে প্রধান অর্থায়নকারী চায়না এক্সিম ব্যাংক।

chinadaily
বঙ্গবন্ধু টানেল । ছবি: চায়না ডেইলি

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলের অর্থায়নের বড় অংশ এসেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে। ২০ বছর মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৭০ কোটি ডলারের বেশি। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রায় ১১৩ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে চীন থেকে। প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) আওতায় চীনা এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির ঋণের অর্থ পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ২ শতাংশ সুদে ২০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগের দুই বছরে দেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ কোটি ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছে সাতটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটিই ছিল চীনের। ওই দুই বছরে ব্যাংক অব চায়না, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না (চায়না এক্সিম ব্যাংক), চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক- এ তিন ব্যাংকের প্রতিটি বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ৫৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এক্সিম ব্যাংক অব চায়না ঋণ দিয়েছে ৪৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার কাছ থেকে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৪০ কোটি ডলার।

চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রমালিকানাধীন নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) যৌথ উদ্যোগে নির্মিত পায়রা কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ