বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৩৬২ কোটি (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বাজেট সহায়তা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯০ কোটি ডলার দিচ্ছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বৈশ্বিক আর্থিক খাতের শীর্ষ সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক দিচ্ছে ৫০ কোটি ডলার। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছ থেকে পাওয়া যাবে ৪০ কোটি ডলার। জাপান সরকার দিচ্ছে ৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ওপেক ফান্ডের কাছ থেকে মিলছে ১০ কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আলোচিত ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দুই কিস্তির (চতুর্থ ও পঞ্চম) ১৩০ কোটি (১.৩ বিলিয়ন) ডলারও পাওয়া যাবে।
সব মিলিয়ে এই ছয় উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে ৩৬২ কোটি (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বড় অঙ্কের ঋণের সবই চলতি জুন মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।
সঙ্কট কাটাতে কম সুদের মোটা অঙ্কের এই ঋণ সহায়তা করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ঋণের খুবই দরকার ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে চাপের মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়বে; অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসতে ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশকে যে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক, বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ ৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। শনিবার (২১ জুন) ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় এ ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও স্থিতিশীলতা বাড়াতে এই অর্থ খরচ করা হবে।
একদিন আগে বৃহস্পতিবার সংস্থাটির বোর্ড সভায় ৬৪ কোটি ডলারের আরেকটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হয়। তা দেওয়া হবে দুটি প্রকল্পের আওতায়। জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা জোরদার প্রকল্পে ৩৫ কোটি ডলার ও বায়ুমান উন্নয়ন প্রকল্পে ২৯ কোটি ডলার।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) ৯০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা অনুমোদন দেয় এডিবি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলায় এডিবির বোর্ড সভায় এই ঋণ অনুমোদনের পরদিন ঢাকায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে এই ঋণের চুক্তিপত্র সই হয়।
এডিবির ৯০ কোটি ডলার ও বিশ্ব ব্যাংকের ৫০ কোটি ডলার—মোট ১৪০ কোটি (১.৪ বিলিয়ন) ডলার বাজেট সহায়তা চলতি জুন মাসেই বাংলাদেশ পাবে বলে ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এছাড়া সোমবার (২৩ জুন) আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংস্থাটির চলমান ৪৭০ কোটি (৪.৭০ বিলিয়ন) ডলার ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির (চতুর্থ ও পঞ্চম) ১৩০ কোটি (১.৩০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের সূচি রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের (আইএমএফ) সব শর্তই পূরণ করা হয়েছে। বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়েছে। তারা আগেই জানিয়েছিল ২৩ জুনের বোর্ড সভায় দুই কিস্তির ঋণ একসঙ্গে অনুমোদেন দেওয়া হবে। তাই আমরা নিশ্চিত সোমবার এই ঋণ অনুমোদন পাবে। আর অনুমোদনের দুই-একদিনের মধ্যেই তা আমাদের রিজার্ভে যোগ হবে।
এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ৪০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। ‘ক্লাইমেট রিসপন্সিভ ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (সিআরইডি)- সাবপ্রোগ্রাম-২’ এর অধীনে এই ঋণ দেবে সংস্থাটি। ২৩ জুন চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে এআইআইবির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সংস্থাটির বোর্ড সভায় এই ঋণ অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে বলে ইআরডির কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ২৪ জুন (মঙ্গলবার) বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এই ঋণের চুক্তিপত্র সই হবে। এই অর্থও জুন মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন ইআরডির কর্মকর্তারা।
মে মাসের শেষদিকে প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফরের পর বাংলাদেশ ৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলার বাজেট সহায়তার ঋণ নিশ্চিত করেছে। জাপান সরকার জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মাধ্যমে ‘ডেভেলপমেন্ট পলিসি লোন ফর ইকোনমিক রিফর্ম অ্যান্ড স্ট্রেংদেনিং ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এই ঋণ দেবে। এই ঋণও চলতি জুন মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে ইআরডি কর্মকর্তারা জানান।
এছাড়া ১০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দিচ্ছে ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট। ‘স্ট্রেংদেনিং ইকোনমিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স প্রোগ্রাম’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এই ঋণ দেবে সংস্থাটি। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকার ও ওপেক ফান্ড এর সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি ঋণচুক্তি সই হয়। ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ওপেক ফান্ডের এদেশে স্থানীয় অফিস না থাকায় কিছু প্রশাসনিক জটিলতায় অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হয়েছে। সেই জটিলতা কাটিয়ে এই ঋণটিও জুন মাসের মধ্যেই রিজার্ভে যোগ হবে।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, সঙ্কটের এই সময়ে বাজেট সহায়তার খুবই দরকার ছিল। সরকার আর্থিক খাতসহ বেশ কিছু খাতে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে বিদেশি ঋণের প্রয়োজন আছে। অর্থনীতিতে সঙ্কট চলছে। তা কাটাতে এই ঋণ সহায়তা করবে বলে আমি মনে করি। বাজেট সহায়তার ঋণ সরাসরি রিজার্ভে হওয়ায় তাতে রিজার্ভ বাড়বে।
তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি পূরণে বাজেট সহায়তা নেওয়া হয়। বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এবং আমাদের রাজস্ব আয় কম হওয়ার কারণে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ হিসাবে বাজেট সহায়তা নিতে হয়। তবে এই ধরনের ঋণের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা আগামী বছরগুলোতে আমাদের ঋণের দায় বাড়াবে। এ কারণে বাজেট সহায়তার বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। যে করেই হোক রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। বাজেটে সহায়তার অর্থ যেন উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।