অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সোমবার (২ জুন) সংসদের বাইরে টেলিভিশনে আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট উপস্থাপন করবেন। এবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাজেটে শুল্ক-করে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। অনেক পণ্যে নতুন করে শুল্ক বসতে পারে, এতে বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে। একই সঙ্গে কর ছাড়সহ কিছু সুবিধাও পাবে কোনো কোনো খাত। এর ফলে ওইসব খাতের পণ্যের দাম কমতে পারে আসন্ন বাজেটে।
দাম বাড়তে পারে
রড, সিমেন্ট ও নির্মাণসামগ্রী: বাজেটে রড, সিমেন্ট ও নির্মাণ খাতের বেশ কিছু দরকারি পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে। যেমন—সিমেন্ট, রড, বার, অ্যাঙ্গল, টাইলস, স্ক্রু, নাট, বোল্ট ও নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে পারে।
সিমেন্ট তৈরির মূল উপকরণ ক্লিংকারের শুল্কায়ন হয় নির্ধারিত মূল্যে। বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টনে ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা কাস্টমস শুল্ক আছে। তবে এখন বাজারমূল্যে নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাতে কাস্টমস শুল্ক ধরা হয়েছে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দর ও বাজারের ওঠানামায় ব্যয়বহুল হতে পারে সিমেন্ট।
রড, বার ও অ্যাঙ্গল তৈরির কাঁচামালের ওপর বসানো হয়েছে বাড়তি শুল্কের বোঝা। বিভিন্ন ধরনের স্ক্রু, নাট ও বোল্ট কিনতে গেলে এখন প্রায় তিন গুণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। এসব পণ্যে মোট করভার ৩৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৯.৩২ শতাংশ করা হয়েছে। টাইলস ও নির্মাণসামগ্রীর মূল উপকরণ মার্বেল ও গ্রানাইট বোল্টারের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে এর মোট করভার ৮৯.৩২ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ১২৭.৭২ শতাংশ।
বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানের খরচ: কনভেনশন হল, কনফারেন্স সেন্টারের সেবার ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের খরচ বাড়বে।
প্লাস্টিক পণ্য: বাজেটে ওয়ান টাইম বা একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দ্বিগুণ হতে যাচ্ছে। এতে চা, কফি থেকে শুরু করে প্লেট ও বাটি ইত্যাদি পণ্যের ওপর ভ্যাট বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ শতাংশ। ফলে এসব প্লাস্টিকের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
হেলিকপ্টারের ভাড়া: হেলিকপ্টারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হতে পারে। যার মধ্যে ১০ শতাংশ শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর থাকছে। এর ফলে হেলিকপ্টারে যাতায়াতে ভাড়া বাড়বে।
আমদানি করা খেলনা: আগামী বাজেটে বিদেশ থেকে আমদানি করা খেলনার দামও বাড়তে পারে। কারণ, বিদেশি খেলনা আমদানির ক্ষেত্রে ট্যারিফ মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি খেলনা ও খেলনার যন্ত্রাংশের ট্যারিফ মূল্য সাড়ে তিন ডলার। আগামী অর্থবছরে প্রস্তুত খেলনা আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি কেজির ন্যূনতম ট্যারিফ মূল্য বাড়িয়ে চার ডলার করা হতে পারে। এতে আমদানি করা বিদেশি খেলনার দাম বাড়তে পারে স্থানীয় বাজারে।
বিদেশি লিপস্টিক, ফেসওয়াশ: বাজেটের পর বিভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য সামগ্রীর দাম বাড়তে পারে। কারণ, লিপস্টিক, লিপলাইনার, আইলাইনার, ফেসওয়াশ, মেকআপের সরঞ্জাম আমদানির ন্যূনতম মূল্য বিভিন্ন হারে বাড়াতে যাচ্ছে এনবিআর। বর্তমানে প্রতি কেজি লিপস্টিক আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য ২০ ডলার। সেটি বাড়িয়ে ৪০ ডলার করা হতে পারে।
বিদেশি চকলেট: চকলেটের দামও বাড়তে পারে। চকলেট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের চকলেটের শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য ৪ ডলার থাকলেও সেটি বাড়িয়ে ১০ ডলার করার প্রস্তাব করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা।
এলইডি লাইট, সয়াবিন মিল, সিগারেট ও অটোরিকশার মত কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়তে পারে। কারণ এসব পণ্যে ৪০ শতাংশের নতুন সম্পূরক শুল্কস্তরও যুক্ত করা হবে।
এছাড়া একটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রিডিয়েন্ট এবং রেডিও ফার্মাসিউটিক্যালস; কৃষি যন্ত্রপাতি; ব্যারিয়ার কন্ট্রাসেপটিভ ও রাবার ল্যাটেক্স; ইলেকট্রনিক্সের মৌলিক উপাদান (রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর, ট্রানজিটর, ইন্ট্রিগ্রেটেড সার্কিট ও মাল্টিলেয়ার পিভিসি); বাই-সাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ; বায়ো ফার্টিলাইজার; বায়োটেকনলজি ভিত্তিক কৃষিপণ্য; বয়লারের খুচরা যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম; আসবাবপত্র; হোম অ্যাপ্লায়েন্স (ব্লেন্ডার, রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইনডাকশন কুকার, ওয়াটার ফিল্টার); কীটনাশক ও বালাইনাশক; চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য; এলইডি টিভি; ফলমূল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াকরণ; মোবাইল ফোন; পেট্রোকেমিক্যাল; ফার্মাসিউটিক্যালস; প্লাস্টিক রিসাইক্লিং; টেক্সটাইল মেশিনারি; টিস্যু গ্রাফটিং; খেলনা উৎপাদন; টায়ার ম্যানুফেকচারিং; ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফরমার; ম্যান মেইড ফাইবার উৎপাদন; অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ ম্যানুফেকচারিং; রোবোটিক্স ডিজাইন; এআই ভিত্তিক সিস্টেম ডিজাইন এবং ম্যানুফেকচারিং, ন্যানোটেকনোলজিভিত্তিক পণ্য ম্যানুফেকচারিং এবং এয়ারক্রাফট হেভি মেইনটেন্যান্স সার্ভিস ও খুচরা যন্ত্রাংশ ম্যানুফেকচারিং আইএমএফের পরামর্শে শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এসব খাতে উৎপাদিত পণ্য ও সেবায় বাড়তি অর্থ গুনতে হতে পারে ভোক্তাকে।
দাম কমতে পারে
চাল, ডাল, আটা, লবণ, ভোজ্যতেল: বাজেটে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে স্থানীয় ঋণপত্রের কমিশনের উৎসে কর কমিয়ে অর্ধেক করা হচ্ছে। এর ফলে চাল, ডাল, আটা, লবণ, ভোজ্যতেলসহ একাধিক কৃষি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমতে পারে।
চিনি: বর্তমানে প্রতি টন পরিশোধিত চিনি আমদানিতে সাড়ে চার হাজার টাকা আমদানি শুল্ক দিতে হয়। আগামী বাজেটে তা কমিয়ে চার হাজার টাকা করা হতে পারে। এনবিআর মনে করছে, চিনির আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে অতীতে বাজার স্থিতিশীল ছিল। এতে রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে।
আমদানি করা অপারেটিং সিস্টেম, ডেটাবেজ: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও ফ্রিল্যান্সাররা সফটওয়্যার তৈরি করতে বিদেশি অপারেটিং সিস্টেম, ডেটাবেজ, ডেভেলপমেন্ট টুলস, সিকিউরিটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকেন। দেশে উৎপাদিত সফটওয়্যার রপ্তানিও হয়। তাই রপ্তানিকে উৎসাহ দিতে বিদেশ থেকে আমদানি করা অপারেটিং সিস্টেম, ডেটাবেজ, ডেভেলপমেন্ট টুলস, সিকিউরিটি সফটওয়্যারে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে বাজেটে।
কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ: কম্পিউটার ও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ এবং সব ধরনের ফল ক্রয়ের জন্য স্থানীয় ঋণপত্রের কমিশনের ওপর উৎসে কর এক শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা হতে পারে।
এলএনজি: আগামী বাজেটে এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে এলএনজি আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয়। আবার গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়। এছাড়া বাইরেও এলএনজি মার্জিনের বিল পরিশোধের সময় গ্যাস বিতরণ সংস্থার কাছ থেকে ৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়। আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির ফলে বিদ্যুৎ, শিল্পের উৎপাদন ও পরিবহন খাতে ব্যয় কমতে পারে।
যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাস: ঢাকাসহ বড় শহরে যানজট কমাতে ১৬ থেকে ৪০ আসনবিশিষ্ট বাস আমদানিতে শুল্ক কমতে পারে। বর্তমানে এ ধরনের যানবাহন আমদানিতে ১০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক বসে। নতুন বাজেটে এই হার কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। অন্যদিকে মাইক্রোবাসের (১০-১৫ আসনবিশিষ্ট) সম্পূরক শুল্ক কমানো হতে পারে। বিদ্যমান ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
পরিবেশবান্ধব পণ্য: পরিবেশবান্ধব পণ্য যেমন সুপারির খোল দিয়ে তৈরি তৈজসপত্র ও হাতে তৈরি মাটির পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি হতে পারে। এসব পণ্য কেনাকাটায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় ক্রেতাকে।
সংবাদপত্রের নিউজপ্রিন্ট: সংবাদপত্রের শিল্পে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক কমানোর প্রস্তাব অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছে এনবিআর। সেই প্রস্তাবে তারা বলেছে, দেশীয় গণমাধ্যমকে আরও সহায়তা দিতে রেয়াতি সুবিধা কিছুটা বাড়ানো প্রয়োজন। সে জন্য কাস্টমস শুল্ক ৫ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।
ক্রিকেট ব্যাট: ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাঁচামাল উইলো কাঠ আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করতে পারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তারা বলেছে, ক্রিকেট ব্যাট এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। ব্যাট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানির চেষ্টা করছে। তবে ব্যাট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উইলো কাঠ আমদানিতে মোট শুল্কহার রয়েছে ৩৭ শতাংশ। সেটিকে কমিয়ে আগামী বাজেটে ২৬ শতাংশ করা হতে পারে।
জমি ও ফ্ল্যাট বেচাকেনায় নিবন্ধন খরচ ও উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব আসতে পারে। স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যাকেটজাত তরল দুধ, পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবারে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করা হতে পারে। জাপানি সিফুড স্ক্যালোপ আমদানিতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। এতে স্ক্যালোপের দাম কমতে পারে। এ ছাড়া দাম কমতে পারে বিদেশি মাখন, ড্রিংক ইত্যাদির। অন্যদিকে দাম কমতে পারে দেশি সিরিশ কাগজের।
রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকারখানায় মালামাল গুদামজাতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল র্যাকিং সিস্টেম ও উৎপাদিত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে মেটাল ডিটেক্টর মেশিন আমদানিতে বর্তমানে যথাক্রমে ৫৮ ও ৩৭ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এই উচ্চ শুল্ক এই শিল্প বিকাশে সহায়ক নয় বলে পণ্য দুটি আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতির সুপারিশ থাকতে পারে বাজেটে।