Home বাণিজ্য বাজেটে নতুন যা থাকছে

বাজেটে নতুন যা থাকছে

ইকবাল হোসেন
২৫ views

নতুন বাস্তবতায় আগামী ২ জুন এবারের জাতীয় বাজেট ঘোষণা হচ্ছে। রাজনৈতিক সরকার নেই। সংসদের বাইরে টেলিভিশনে বাজেট উত্থাপন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বেশ কিছু নতুন দিক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- প্রথমবারের মতো ছোট হচ্ছে  বাজেটের আকার, ঢেলে সাজানো হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, করহার বাড়িয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে, জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি ও করহার কমছে, ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে ও  বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমছে।  

প্রথমবারের মতো কমছে আকার
এবারই প্রথম সংকোচনমূলক জাতীয় বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। ঋণের সুদ পরিশোধে খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় বাজেটের আকার ছোট করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় তা সাত হাজার কোটি টাকা কম। শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা উন্নয়ন বাজেট অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো হচ্ছে
অন্তর্বর্তী সরকার আসন্ন জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করছে। মূলত এসব কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা আনতেই এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বাড়ানো হবে, তবে বিদ্যমান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কর্মসূচি বাতিল হতে পারে। বর্তমানে যেখানে ১৪০টি কর্মসূচি আছে, সেখানে নতুন ব্যবস্থায় ১০০টির নিচে নামিয়ে আনা হবে। এর মধ্যে ৩৮টি কর্মসূচিকে ‘দরিদ্রবান্ধব’ হিসেবে ধরা হবে।

মূল নগদ সহায়তা কর্মসূচিগুলোর অধীনে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী অর্থবছরে মাসিক ভাতা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এরমধ্যে বয়স্ক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হবে। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুস্থ নারী ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হবে এবং জাতীয় বাজেটে নতুন ১ লাখ ২৫ হাজার নারী এতে যুক্ত হবেন। বর্তমানে উপকারভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৭৫ হাজার। শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভাতা কর্মসূচির আওতায় মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করা হবে। এ ছাড়া এবারের জাতীয় বাজেটে ২ লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবেন, বর্তমানে এই সংখ্যা ৩২ লাখ ৩৪ হাজার। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিতে মাসিক ভাতা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হবে। এই কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ১৭ লাখ ৭১ হাজারে উন্নীত হতে পারে।

করহার বাড়িয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে নির্দিষ্ট খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে, স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও জমি কেনার ক্ষেত্রে এই সুযোগ। তবে, এই ক্ষেত্রে করহার সর্বোচ্চ সাত গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। বিশেষ করে, ঢাকার গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মতিঝিলসহ অভিজাত এলাকার জমির ওপর প্রতি বর্গমিটারে করের পরিমাণ বর্তমানে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা থাকলেও সেটা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫ হাজার টাকায় উন্নীত হতে পারে। এতে করে জমি ও সম্পত্তির নিলাম প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়তে পারে এবং প্রকৃত মূল্য দেখানোর প্রবণতা বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। 

জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি ও করহার কমছে
আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জাতীয় বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) ফি ও করহার প্রায় ৪০ শতাংশ কমানো হচ্ছে। পাশাপাশি মৌজা মূল্য থেকে সরে এসে বাজারমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্পত্তির দলিল মূল্য নির্ধারণ করা হবে। বর্তমানে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিভিন্ন ধরণের কর ও ফি রয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি কমিয়ে ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে।
জমি ও ফ্ল্যাটের মৌজা মূল্য বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় বর্তমানে, বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতা বেশি দামে জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচা করলেও— রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য মৌজা মূল্য অনুযায়ী কম দাম দেখিয়ে দলিল করে। দলিল মূল্যের অতিরিক্ত টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে লেনদেন করে, যা মূলত কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ। এতে বিপুল রাজস্ব বঞ্চিত হয় সরকার। 

করমুক্ত আয়সীমা পৌনে ৪ লাখ টাকা হবে
আগামী অর্থবছরে বাড়তে পারে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা। বর্তমানে বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত আয়সীমা রয়েছে। এই সীমা আরও ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হবে। এছাড়া ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, পৌর এলাকা, গ্রাম এলাকা নির্বিশেষে ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার করা হতে পারে।

বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমছে
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ভর্তুকি বাবদ ৬২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কারণে এ দুটি খাতের বকেয়া ভর্তুকি দায় প্রায় পুরোটাই মেটানো সম্ভব হবে। ফলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ভর্তুকির পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা ভর্তুকিতে বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। চলতি অর্থবছরে এ দুটি খাতে ভর্তুকিতে বরাদ্দ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণকে সামনে রেখে রপ্তানিতে নগদ সহায়তা বাবদ ভর্তুকির পরিমাণও কমছে।

উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ও রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর নেই
নতুন বাজেটে থাকবে না অতীতের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের ঘটা কিংবা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর। বরং বাস্তবায়নযোগ্য ও মিতব্যয়ী বাজেট তৈরির দিকেই জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের যে বাজেট আসছে, এটা শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের বাজেট। বাজেটের ছোট হলেও বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট হবে এবার। এ বাজেটে আমাদের রাজস্ব বৃদ্ধি করার চেষ্টা থাকবে।

বাজেট ব্যবস্থাপনা টেকসই করা হলো আমাদের মূল লক্ষ্য। টাকা ছাপিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করবো না। তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে এমন প্রকল্প নেওয়া হবে না। বাজেট ব্যবস্থাপনা টেকসই করা হবে। বাজেটের নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা ফেরানো হবে। টাকার অঙ্কে ছোট হলেও বাস্তবসম্মত বাজেট হবে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, এবারের জাতীয় বাজেটকে কোনোভাবেই উচ্চাভিলাষী বাজেট বলা যাবে না। এ বাজেটে অবাস্তব ও অবাস্তবায়নযোগ্য কোনো মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হবে না। তবে এটা ঠিক, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, তাই বাজেটের আকার ছোট করছি। এবারের বাজেট হবে বাস্তবসম্মত, কল্যাণমুখী ও সমতাভিত্তিক।

 

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ