আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) ফি ও করহার প্রায় ৪০ শতাংশ কমানো হচ্ছে। পাশাপাশি মৌজা মূল্য থেকে সরে এসে বাজারমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্পত্তির দলিল মূল্য নির্ধারণ করা হবে। আবাসনখাতে কালো টাকার ব্যবহার কমিয়ে আনা ও রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিভিন্ন ধরণের কর ও ফি রয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি কমিয়ে ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে।
সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যা ক্রেতা-বিক্রেতাকে বড় ধরণের কর ছাড় দেওয়ার পরও— আবাসন খাতে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব আহরণ বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সভায় আইন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জমির আনুষ্ঠানিক রেকর্ডের সবচেয়ে ছোট ইউনিট হচ্ছে মৌজা। নিবন্ধিত মূল্যকে বিবেচনায় নিয়ে জমির মৌজা মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। প্রায় সকল দলিল মৌজা মূল্যে নিবন্ধিত হয়, যা সাধারণত প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম হয়। জমি ও ফ্ল্যাটের মৌজা মূল্য বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় বর্তমানে, বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতা বেশি দামে জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচা করলেও— রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য মৌজা মূল্য অনুযায়ী কম দাম দেখিয়ে দলিল করে। দলিল মূল্যের অতিরিক্ত টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে লেনদেন করে, যা মূলত কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ। এতে বিপুল রাজস্ব বঞ্চিত হয় সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি ও কর বাবদ সরকারের মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে উৎসে কর বা গেইন ট্যাক্স থেকে, যার পরিমাণ ৬ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা এবং স্থানীয় সরকার কর বাবদ ৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া, রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ১ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাব অনুযায়ী, দলিলে কম দাম দেখানোর কারণে বছরে গড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারায় সরকার।
এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে, প্রস্তাবিত কর কমানো সত্ত্বেও যদি সম্পত্তি প্রকৃত বাজারমূল্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা যায়, তাহলে মোট রাজস্ব আয় বরং বাড়বে।
২০১০ সালে প্রণীত ‘সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজার মূল্য নির্ধারণ বিধিমালা’র আওতায়, পূর্ববর্তী দুই বছরের নিবন্ধিত মূল্যকে বিবেচনায় নিয়ে— জমির মৌজা মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। প্রায় সকল দলিল মৌজা মূল্যে নিবন্ধিত হয়— বলে পরবর্তী বছরগুলোতে মৌজা মূল্য বাড়ে না। তবে সময়ে সময়ে কিছুটা বাড়িয়ে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০১১ এবং ২০১৬ এর নির্ধারিত মৌজা মূল্যকে ভিত্তি ধরে সর্বশেষ ২০২১ সালে নতুন মৌজা মূল্য নির্ধারণ করেছে।
মৌজা মূল্যকে বাজার মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণের জন্য— এই বিধিমালায় নতুন বিধান সংযোজন করে মৌজা মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার। এজন্য বিভাগীয় কমিশনারদের নেতৃত্বে দেশের সকল সিটি করপোরেশন এলাকা এবং জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে জেলার পৌরসভা এলাকার জমির বাজারমূল্য নির্ধারণে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত নতুন পদ্ধতিতে একটি মৌজায় একই শ্রেণীর জমির দুই বছরে সম্পাদিত সকল দলিলের মূল্যের গড়কে ভিত্তি ধরে গোপন ও প্রকাশ্য তদন্ত করে বা গণশুনানির মাধ্যমে প্রকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বাজারমূল্য গড়মূল্যের কম হবে না, এবং সর্বনিম্ন বাজারমূল্য গড়মূল্যের দ্বিগুণের অধিক হলে তার বিস্তারিত ভূমি সচিব ও আইন সচিবকে জানাবে কমিটি।
একই মৌজায় একই শ্রেনীর জমির মূল্যে অবস্থানভেদে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকলে— ওই মৌজাকে ভেঙ্গে একাধিক ক্লাস্টারে ভাগ করতে পারবে কমিটিগুলো। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথ সমন্বয়ের মাধ্যমে বাজারমূল্যে জমির মূল্য নির্ধারণ করবে, এবং প্রতিবছর নিয়মিতভাবে বাজারমূল্য হালনাগাদ করবে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডাটাবেজে এ তথ্য নিয়মিতভাবে প্রকাশ করবে সরকার।
এনবিআর সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে রেজিস্ট্রেশন ফি ১ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকলেও স্ট্যাম্প ফি ১.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে আনার প্রস্তাব আসছে। স্থানীয় সরকার কর ও গেইন ট্যাক্স নিয়েও ছাড়ের চিন্তা রয়েছে; যাতে সম্মিলিতভাবে কর ও ফি ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে থাকে।
জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের সময় গেইন ট্যাক্স বা উৎসে কর সকল ক্ষেত্রে অর্ধেক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে ঢাকার ক-ঘ শ্রেণীর ক্ষেত্রে উৎসে কর ৮ শতাংশ, এবং ঙ- শ্রেণীর ক্ষেত্রে এবং চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ উৎসে কর রয়েছে। নতুন অর্থবছর থেকে ঢাকার ক-ঘ শ্রেণীর ক্ষেত্রে উৎসে কর ৪ শতাংশ, এবং ঙ- শ্রেণী এবং চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করা হতে পারে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা বাদে— অন্যান্য পৌরসভার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ৪ শতাংশ উৎসে কর কমিয়ে ২ শতাংশ করা হতে পারে। এছাড়া, পৌরসভা ব্যাতিত অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে বিদ্যমান উৎসে কর বিদ্যমান ২ শতাংশ হতে কমিয়ে ১ শতাংশ আরোপ করা হতে পারে।