নৈতিক সমতার দাবীতে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আজ শুক্রবার দুপুর থেকে শুরু হয়েছে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচি। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে আয়োজনটি শুরু হয়। নির্ধারিত সময়ের আগে থেকেই বিভিন্ন ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে বহু ক্ষেত্রকে উপস্থাপন করতে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আসতে থাকেন। তাদের মাঝে রয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের স্বজন, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শিল্পী, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা-বাগানের শ্রমিক, যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী, হিজড়া, লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যময় ও অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ, তরুণী ও তরুণেরা, শিক্ষার্থী, আদিবাসী, অবাঙালি এবং আরও অনেকে।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সমতা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার কেবল কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর দাবি নয়—এগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রাপ্য ও ন্যায্য অধিকার। বাংলাদেশে কৃষি, মৎস্যজীবী ও গৃহকর্ম পেশায় নারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। এখনো একই কাজে নারীরা পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পান। দলিত, হরিজন ও আদিবাসী নারীরা জাতিগত নিপীড়নের শিকার হন। পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীদের ওপর চলে সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতন। আজকে যখন অধিকারের দাবিতে আমরা সমবেত হয়েছি, তখন বম নারীরা কারাগারে বন্দি। বাংলাদেশের শতকরা ৯৬ ভাগ নারী আজও ভূমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত।
এশিয়ায় বাল্যবিবাহের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ; প্রতিনিয়ত নারীরা বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌন নিপীড়নের মতো গুরুতর অপরাধের মামলায় ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বিচার হয় না। অভিন্ন পারিবারিক আইন না থাকায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি বা জটিলতার কারণে সম্পত্তি, বিবাহবিচ্ছেদ ও বিচ্ছেদের পর সন্তানের অভিভাবকত্ব পাবার অধিকার থেকে বহু নারী বঞ্চিত। এখনো যৌনকর্মীদের নাগরিক সুরক্ষা নেই। এখনো লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের মানুষদের স্বীকৃতি নেই। অহরহই প্রবাসী নারীশ্রমিক দেশে ফিরেছে লাশ হয়ে। এ সকল কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধেই আমাদের সংঘবদ্ধ লড়াই, আমাদের লক্ষ্য সাম্য ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা।
মৈত্রী যাত্রার ঘোষণাপত্রে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত এবং গুজব ও ধর্মীয় উসকানির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিশেষভাবে দাবি জানানো হয়েছে।
ঘোষণাপত্র আরও বলা হয়েছে, ”আমাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা আমরা মেনে নেবো না। আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র আমরা প্রতিরোধ করবো। বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে দমনমূলক অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা আমরা প্রতিরোধ করব। ইতিহাসবিচ্ছিন্ন কূপমণ্ডুকতার মাধ্যমে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে আমরা কিছুতেই সফল হতে দেবো না। আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময় এবং সংবেদনশীল। সেই বিশালতাকে উপেক্ষা করে আমরা গুটি কয়েক মানুষের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সার্বজনীন হতে দেবো না। আমরা অধিকার ও ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেবো না, মর্যাদা নিয়ে কোনো ধরনের দ্ব্যর্থকতা মেনে নেবো না। আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারী বিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখবো। যে ক্ষমতাকাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, আমরা সেই কাঠামোকে ভাঙবো”।