ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং মিডিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। সম্প্রতি ‘হ্যালো বাংলাদেশ’র সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, সাংবাদিকতা, আগামীর বাংলাদেশসহ নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘হ্যালো বাংলাদেশ’র তাওহীদ মাহমুদ।
হ্যালো বাংলাদেশ: বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আপনার মতামত কী? বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি থাকা উচিত কি?
রোবায়েত ফেরদৌস: ছাত্র রাজনীতি থাকতে পারে কিন্তু লেজুড়বৃত্তির যে ছাত্র রাজনীতি আমরা দেখি সেটা আসলে একেবারেই ঠিক না। আমি এর সাথে একমত না। ছাত্ররা রাজনীতি করবে তাদের স্বার্থ নিয়ে। তারা রাজনীতি করবে তাদের হলের সিট নিয়ে, ক্লাসে শিক্ষকরা ঠিকভাবে পড়াচ্ছেন কিনা, সময়মতো পরীক্ষা হচ্ছে কিনা। শিক্ষা, গবেষণা নিয়ে তারা রাজনীতি করবে, আন্দোলন করবে।
কিন্তু আমরা যেটা দেখতে পাই, ছাত্রদল হচ্ছে বিএনপির একটি অঙ্গ সংগঠন, ছাত্রলীগ হচ্ছে আওয়ামী লীগের একটি ছাত্র সংগঠন, ছাত্রশিবির জামাতের একটি ছাত্র সংগঠন। বাংলাদেশের এই দলগুলো ছাত্রদেরকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ হাসিল করে। এই লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির পক্ষে আমি না।
হ্যালো বাংলাদেশ: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি বা শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন রঙের দল নিয়ে আপনার মতামত কী?
রোবায়েত ফেরদৌস: শিক্ষক রাজনীতি যদি প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতির জন্য থাকে, তবে সেটি সাধারণত ইতিবাচক। কিন্তু যদি এটি ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহৃত হয় তাহলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য— শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আমি মনে করি, শিক্ষকরা আসলে কোনো রাজনৈতিক দলের হতে পারে না। তারা দলের হলে তারা আসলে সঠিকভাবে ছাত্রদেরকে মূল্যায়ন করতে পারবে না।
শিক্ষক রাজনীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নীল দলকে আমি মনে করি আওয়ামী লীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, সাদা দলকে মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিএনপি শাখা। শিক্ষকরা রাজনৈতিক দল পছন্দ করতে পারেন, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। শিক্ষক রাজনীতি হবে শিক্ষকদের অধিকার, গবেষণা এবং প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। যখন শিক্ষক রাজনীতি নেতিবাচকভাবে প্রকাশ পায়, তখন সেটি শিক্ষার পরিবেশ, প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতা এবং শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে।
হ্যালো বাংলাদেশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট কী ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করছে?
রোবায়েত ফেরদৌস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা না থাকা একটি বড় সমস্যা। আবাসন সংকটের ফলে শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে দূর-দূরান্ত থেকে আসা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরা অনেক সময় শিক্ষার প্রতি তাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। দুঃখের বিষয়, আমাদের এসএম (সলিমুল্লাহ মুসলিম) হলে একজন শিক্ষার্থী বারান্দায় থাকতে গিয়ে নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে আবাসন সংকট শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং এটি পুরো বাংলাদেশের শিক্ষা ও সমৃদ্ধি প্রক্রিয়ার জন্য একটি বড় বাধা।
হ্যালো বাংলাদেশ: এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী?
রোবায়েত ফেরদৌস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আধুনিক ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা গড়ে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। প্রয়োজনীয়ভাবে ছাত্রাবাস এবং অন্যান্য সুবিধার জন্য স্থায়ী ও টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। শিক্ষার্থীদের জন্য সুষ্ঠু ও সাশ্রয়ী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনা করতে পারে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানও উন্নত হয়।
হ্যালো বাংলাদেশ: আপনি ভিসির বাসভবন নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন, যেটি মিডিয়াতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি পাঠকদের জন্য স্পষ্ট করবেন।
রোবায়েত ফেরদৌস: আমি মনে করি, ঢাবি ভিসির এত বড় বাসভবন প্রয়োজন নেই। এটা অপচয়। এখানে একটি মিউজিয়াম হতে পারে, যেখানে ২০২৪ অভ্যুত্থানের সকল বিষয় থাকবে এবং সামান্য কিছু প্রবেশ মূল্য দিয়ে মানুষ তা পরিদর্শন করবে। সেই টাকা এই আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের বিষয়ে খরচ হতে পারে। আরেকটা ভিসি ভবন হতে পারে, যেখানে ভিসি, প্রো-ভিসিরা এক সাথে থাকতে পারবেন।
হ্যালো বাংলাদেশ: সরকার স্বৈরাচার হওয়ার পিছনে দোষ কার?
রোবায়েত ফেরদৌস: দেখুন, আমি মনে করি দোষ হাসিনারও না, খালেদারও না। যে সংবিধান আর রাষ্ট্র কাঠামো বানিয়েছি, তার স্ট্র্যাকচারটাই হচ্ছে স্বৈরাচারে পরিণত করা। তাই ক্ষমতাকে কিভাবে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করা যায় সেটি ভাবতে হবে। সংবিধান সংস্কার করতে হবে এবং এর সমালোচনাও করতে হবে।
হ্যালো বাংলাদেশ: সাংবাদিকরা কি কোনো দলের হতে পারে?
রোবায়েত ফেরদৌস: সাংবাদিকতার বইয়ের প্রথম লাইন হচ্ছে- পৃথিবীর প্রত্যেকটা সরকার মিথ্যা বলে, প্রত্যেকটা সরকার তথ্য লুকাতে চায়। সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে সত্য তুলে এনে প্রকাশ করা। কিন্তু বিগত সময়ে স্বাধীন সাংবাদিকতা দেখিনি। সাংবাদিকতাকে ‘শিল্পের পর্যায়ে’ নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সম্পাদকরা।
হ্যালো বাংলাদেশ: কেমন বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেন?
রোবায়েত ফেরদৌস: বাংলাদেশ সব মানুষের দেশ হয়নি। হয়েছে লুটেরা, ভূমিদস্যু, পাচারকারী, সালমান এফ রহমান, শামীম ওসমান, বেনজীর, মতিউরের রাষ্ট্র। আমার-আপনার রাষ্ট্র হয়নি। জনগণের রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে।
হ্যালো বাংলাদেশ: তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য কি হওয়া উচিত?
রোবায়েত ফেরদৌস: এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে জনগণের মতামত এবং স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ হবে। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকবে, যেখানে নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে শিক্ষার মান উন্নত হবে এবং সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। যাতে দেশের জনগণ সুশিক্ষিত, সচেতন এবং নিজেদের সংস্কৃতিতে গর্বিত হয়ে উঠবে।
মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, বিশেষ করে গরিব, নারী, সংখ্যালঘু ও দরিদ্র জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে মিডিয়া স্বাধীন থাকবে এবং সাংবাদিকতা একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করবে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে।