গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীসহ সারা দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ৬০ দিনের জন্য বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয় সরকার। গতকাল বুধবার ছিল তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাপ্রাপ্তির ৫৯তম দিন। গত দুই মাসে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ৬ হাজারের বেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ২ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এসব ঘটনায় আড়াই হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশে হস্তান্তর করেছে।
এছাড়া সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, ত্রিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ছয়শর বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর এসব কার্যক্রম নিয়ে গতকাল বুধবার সেনা সদর দপ্তরের বনানী রেলক্রসিং-সংলগ্ন ‘অফিসার্স মেস-এ’তে এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী কতদিন মাঠে থাকবে, অন্তর্বর্তী সরকারই তা নির্ধারণ করবে। কারণ সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তে। সরকার নির্ধারণ করবে সেনাবাহিনী কত দিন মাঠে থাকবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা যেন সুষ্ঠুভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা হয়, সে বিষয়ে সেনাবাহিনী সতর্ক আছে।
তিনি দাবি করেন, সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পর অপরাধের সংখ্যা অনেক কমেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি, তবে যতটুকু আশা করা গেছে সে অনুযায়ী উন্নতি হয়নি। পুলিশ বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের কার্যক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে। অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এসএসএফের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, ‘এসএসএফের ভারী অস্ত্র খোয়া যায়নি। কিছু পিস্তল খোয়া যায়। সেটার সন্ধানে কার্যক্রম চলছে।’
বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ:গত দুই মাসে ছয়শর বেশি বিভিন্ন ধরনের ‘বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি’ নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৪১টি, সরকারি সংস্থা ও অফিস সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ৮৬টি ও রাজনৈতিক দলের ঘটনা ছিল ৯৮টি। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে দেশে তৈরি পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়। এ ব্যাপারে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং কারখানাগুলো চালু করতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের ৬২ জেলায় সেনাসদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহায়তা করছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, ‘ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্বটা পুলিশের। যেখানে আমাদের সহায়তার প্রয়োজন, আমরা সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।’ তিনি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে আহত ৩২৯৫ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসা দিয়েছে। বর্তমানে ৪৩ জন সেনাবাহিনীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধে সচেতন:
সেনাবাহিনী মাঠে থাকা অবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে কি না, ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে সেনাবাহিনী অত্যন্ত সচেতন রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আদেশ রয়েছে। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতিতে যেন আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা সংঘটিত হতে না দেই, আমাদের সেই চেষ্টা রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন না ঘটে, এ ক্ষেত্রেও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে।’
সেনাসদস্যরা এক ব্যক্তিকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন—এমন একটি ভিডিওর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, পরিস্থিতির প্রয়োজনে অনেক কিছু করতে হয়, তবে সেনাবাহিনী টার্গেট করে কাউকে মেরেছে এমন কোনো ঘটনা হয়নি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুলশানে একজন মেজরের সঙ্গে একজন পুলিশ কর্মকর্তার ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝি থেকে হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক খুবই ভালো। এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চাকরিচ্যুত ও পলাতক মেজর জিয়াউল হক জিয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর কাছে কোনো তথ্য নেই। তথ্য পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিদেশি কূটনীতিক, দূতাবাস ও কারখানার নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার কাজটিও সেনাবাহিনী করছে বলে তিনি জানান।