Home বাণিজ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৩৮ views

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দূর্বল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেমন বাংলাদেশে আসতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না, তেমনি বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যেও গতি আসে না।

বিশ্বব্যাংকের নতুন এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ‘বিজনেস রেডি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি  গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয়েছে। এটি মূলত ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ‘সহজে ব্যবসার সূচক’ শীর্ষক প্রতিবেদনের বিকল্প। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ কেমন, তা নিয়ে নিয়মিত সহজে ব্যবসার সূচক প্রকাশ করত বিশ্বব্যাংক। কিন্তু ২০২১ সালে সেই প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় বহুজাতিক সংস্থাটি সেটির প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। এখন তারা নতুন করে বিজনেস রেডি প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।

কোনো কোম্পানির কাজ শুরু করা, পরিচালনা ও বন্ধ করা এবং প্রতিযোগিতার কাজের ধরন পরিবর্তনের মতো ১০টি বিষয়ের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ সারিতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ ১০০-এর মধ্যে আইনি কাঠামোতে ৫১ দশমিক ৫৬, সরকারি সেবায় ২৯ দশমিক ৫২ ও পরিচালনাগত দক্ষতায় ৮০ দশমিক ৫০ পয়েন্ট পেয়েছে। গড় পয়েন্ট ৫৩ দশমিক ৮৬। এর অর্থ হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় আইন, সরকারি সেবা ও পরিচালনাগত সমস্যা আছে। 

এবারের প্রতিবেদনে বিভিন্ন শ্রেণিতে ৫০টি দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ কেবল একটি শ্রেণিতে প্রথম সারিতে আছে। সেটি হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থান। এই শ্রেণিতে বাংলাদেশ পেয়েছে ৬৬ দশমিক ৯১ পয়েন্ট। ব্যবসা শুরু, শ্রম ও আর্থিক সেবায় আছে দ্বিতীয় সারিতে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থান বিরোধ নিষ্পত্তিতে। এই শ্রেণিতে বাংলাদেশ একদম নিচের সারিতে, অর্জিত মান ৪১ দশমিক ৯০। এ ছাড়া বাজারের প্রতিযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অসচ্ছলতা ও পরিষেবায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ সারিতে। কর ও আর্থিক সেবায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় সারিতে, মান ৫৬ দশমিক ৩৬।

২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হওয়ার কথা। এসডিজি অনুযায়ী সরকারের লক্ষ্য, আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চতুর্থ সারিতে থেকে সেই লক্ষ্য কতটা অর্জন করা সম্ভব, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশগুলোকে ভবিষ্যতের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতকে আরও গতিশীল করতে হবে। আগামী এক দশকে গড়ে প্রতিবছর ৪ কোটি ৪০ লাখ তরুণের কর্মসংস্থান হতে হবে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশই আফ্রিকায়। চরম দারিদ্র্য দূরীকরণে অধিকাংশ নিম্ন আয়ের দেশকে আগামী এক দশকে গড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। মধ্য আয়ের ফাঁদ এড়াতে হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দীর্ঘ সময় গড়ে ৫ শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।

6206720 1
ছবি: ফ্রিপিক

সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনসহ টেকসই উন্নয়নের অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে গড়ে প্রতিবছর ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের উন্নয়নে জোর দেওয়ার বিকল্প নেই। যে বিনিয়োগে কেবল উদ্যোক্তা নন; বরং ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নয়ন হবে, তেমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী সময়ে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তখন বাজার সুবিধা থাকবে না, ফলে সক্ষমতা না বাড়লে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে অনেকগুলো সূচক ও উপসূচক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও এসব বিষয় নতুন কিছু নয়। দেশের অর্থনীতিবিদেরাও অনেক দিন ধরে এ কথাগুলো বলে আসছেন। কিন্তু দেশের বিশেষ উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন সমস্যার কারণে আমদানি ব্যয় যেমন বেড়ে যায়, তেমনি রপ্তানির বহুমুখীকরণ হয় না। বেড়ে যায় উৎপাদন ব্যয়। শেষমেশ যার চাপ গিয়ে পড়ে ভোক্তাদের ওপর। ফলে এসব সমস্যা ধরে ধরে এখন সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

অন্যান্য প্রতিবেদনেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ের পরিবেশের অবনতি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিকভাবে ব্যবসা পরিবেশ সূচকে স্কোর ছিল ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ৫৮ দশমিক ৭৫; ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৬১ দশমিক ৯৫ পয়েন্ট। অর্থাৎ এক বছরে স্কোর ৩ দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ঢাকা ও গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের (পিইবি) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গত বছর  বিশ্বব্যাংক বিজনেস রেডি প্রজেক্টের আওতায় নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলে জানায়। এটি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে। 

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ডুয়িং বিজনেস রিপাের্টের প্রকাশনা বন্ধের ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। বিভিন্ন দেশের ব্যবসার সূচক সম্পর্কিত এই প্রতিবেদন তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের পর এ সিদ্ধান্ত জানায় সংস্থাটি। এর আগে ২০২০ সালের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর পরবর্তী প্রতিবেদন প্রকাশ স্থগিত করা হয়।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উঠে আসা নানা দিক উল্লেখ করা হয় সিএনএনের এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০১৮ ও ২০২০ সালের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টে চীন ও সৌদি আরবের র‍্যাংকিং এগিয়ে নিতে প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের ‘অনৈতিক চাপ’ দিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তারা।

২০১৮ সালে চীন প্রথমে যে অবস্থানে ছিল, পরে তার থেকে আরও সাত ধাপ এগিয়ে যায়। এই অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম এবং সিইও ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ২০২০ সালের প্রতিবেদনে সৌদি আরবের র‌্যাংকিং এগিয়ে নেওয়ার পেছনে নাম আসে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও বেসরকারি খাতবিষয়ক সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট সিমিয়ন জনকোভের। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টে অসংগতির প্রথম অভিযোগ পাওয়া যায় ২০১৭ সালে। ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে চিলির অবস্থান ছিল ৩৪তম। ২০১৭ সালে তা হয় ৫৫তম। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন চিলির প্রেসিডেন্ট ও সরকারি কর্মকর্তারা।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ