Home বাংলাদেশ ভারত ভিসা কমিয়ে দেওয়ায় যে প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে

ভারত ভিসা কমিয়ে দেওয়ায় যে প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯৬ views

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয় দূতাবাস কিছুদিন ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রেখে আবার চালু করেছে। তবে অত্যন্ত সীমিত আকারে চলছে সেই কার্যক্রম। সাধারণত কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণসহ ১৫টি ক্যাটাগরিতে ভারত বাংলাদেশকে ভিসা দিয়ে থাকে। তবে বর্তমানে শুধুমাত্র শিক্ষা ও জরুরি চিকিৎসার জন্য ভিসার আবেদন করা যাচ্ছে।

ভারতের এই ভিসা জটিলতার কারণে কমেছে দুই দেশের ফ্লাইট সংখ্যা, সংকটে পড়েছে ইউরোপে পড়তে ইচ্ছুক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। একই সাথে ভারতের পর্যটন ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। প্রভাব পড়েছে ভারতের স্থানীয় ব্যবসাতেও।

ইউরোপে পড়তে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়ছেন। কারণ ইউরোপের অনেক দেশের দূতাবাস ভারতে। এমনকি চিকিৎসার জন্য ভিসা পেতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। সীমিত ভিসা দেওয়ার প্রভাব পড়ছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।

অর্ধেকে ফ্লাইট সংখ্যা  
ভিসা জটিলতার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সম্ভবত এয়ারলাইন্স ব্যবসায়। বাংলাদেশের তিনটি বিমান সংস্থা নভোএয়ার, ইউএস-বাংলা ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ভারতে ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। ভিসা জটিলতায় যাত্রী যেতে না পারায় এর মধ্যে দুইটি বিমান সংস্থার ফ্লাইট কমে অর্ধেকে নেমেছে, আর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে একটির। 

nbs24 06 10 24 07
ছবি: বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করতো ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-চেন্নাই ও চট্টগ্রাম-কলকাতা– এ তিন রুটে সপ্তাহে মোট ৩২টি ফ্লাইট পরিচালনা করতো সংস্থাটি। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে দুইটি রুটে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১২তে। আর পুরোপুরি বন্ধ আছে চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে উড়োজাহাজ চলাচল।

একই অবস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। আগে ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-চেন্নাই ও ঢাকা-দিল্লি রুটে সপ্তাহে ২৮টি ফ্লাইট পরিচালিত হলেও বর্তমানে চলছে মাত্র ১৩টি ফ্লাইট।

আর পুরোপুরি বন্ধ আছে কেবল ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচলকারী নভোএয়ারের ফ্লাইট। সংস্থাটির মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস বিভাগ জানায়, আগে প্রতিদিন নভোএয়ারের একটি করে ফ্লাইট ঢাকা থেকে কলকাতায় গেলেও যাত্রী কমার পর তা কমিয়ে সপ্তাহে তিনটি করা হয়। তবে ১৬ তারিখ থেকে ফ্লাইট চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে সংস্থাটি।

ভিসার কারণেই ফ্লাইট সংখ্যা কমে গেছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগ জানায়, যারা এখনো ট্রাভেল করছেন তাদের আগের ভিসা ছিল। হয়তো কিছুদিন পর সেই ভিসাগুলো শেষ হয়ে গেলে ফ্লাইটের সংখ্যা আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যদি ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা এর মধ্যে ক্লিয়ার না হয়।

ভারত চিকিৎসা ভিসা দিলেও চেন্নাইগামী ফ্লাইটের সংখ্যাও ‘আপ টু দ্য মার্ক’ না। এছাড়া ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ লোড নিয়ে ফ্লাইটগুলো অপারেট করতে হচ্ছে বলেও জানা যায়।

এদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগ জানায়, যাত্রী যাওয়ার প্রবাহ কমে গেছে।  ফলে অনেক ফ্লাইট আন্ডারলোড যাচ্ছে। তাই এটা কমিয়ে নিয়ে এসে এডজাস্ট করছে সংস্থাটি যাতে  অপারেটিং কস্ট উঠে আসে।

তবে ভিসা আবার আগের মতো দেওয়া শুরু হলে এবং যাত্রী চাপ বাড়লে আবারও আগের মতো ফ্লাইট পরিচালনা করা যাবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

বেকায়দায় ইউরোপে পড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা  
ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশি কোনো শিক্ষার্থীকে ইউরোপের দেশগুলোতে পড়তে যেতে হলে ভারতে গিয়ে সেই দেশের দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের প্রথমে ভারতের ভিসা প্রয়োজন হয়। 

3ff23930 8386 11ef 822c a50726bfda2e.jpg
ছবি: বিবিসি বাংলা

কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টের দুদিন পর থেকে ভারতীয় দূতাবাস ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রাখে। প্রায় এক সপ্তাহ পর দেশটি ‘সীমিত আকারে’ ভিসার কাজ চালু করে। রোমানিয়া, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে পড়তে যেতে আগ্রহী সব শিক্ষার্থীরই এই সমস্যা হচ্ছে।

১৫টি ক্যাটাগরিতে ভারত বাংলাদেশকে ভিসা দেয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কেবল শিক্ষা ও জরুরি চিকিৎসার জন্য ভিসা আবেদন করা যাচ্ছে। তবে সে ক্ষেত্রেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ভিসা আবেদনকারীদের।

পর্যটন ব্যবসায় ধস  
ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকায় ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ব্যবসার অবস্থা বেশ খারাপ। কারণ এখান থেকে যে দেশগুলোর ভিসার জন্য আবেদন করা হয়, তার বড় একটি অংশই ভারতের। 

একজন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ব্যবসায়ী জানান, আগে যেখানে কেবল ভারতের জন্য মাসে ১২শ থেকে ১৫শ ফাইল রেডি করা হতো, সেখানে গত এক মাসে ‘ইমার্জেন্সি কেসের’ মাত্র ১০০টি ফাইল রেডি করা গেছে। আর সাবমিট করতে পেরেছেন কেবল আট থেকে ১০টি ফাইল।

ভোগান্তিতে পড়েছে ভারতের ব্যবসায়ীরাও  
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশটিতে পর্যটন খাতে ভ্রমণের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ, যা কিনা সে দেশে মোট বিদেশি পর্যটকের ২১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। 

ফলে ভিসা না দেওয়ায় কেবল যে বাংলাদেশিরাই ভোগান্তিতে পড়ছে, তেমনও না। ভিসা কার্যক্রম সীমিত থাকায় সমস্যায় পড়েছেন ভারতের পর্যটন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও।

কলকাতার একজন ব্যবসায়ী জানান, বাংলাদেশে যে ঘটনাটা ঘটল, শুরুতে তাতে একটা ধাক্কা লেগেছে। প্রথম কিছুদিন আমরা ক্লিয়ারলি দেখতে পাই, মানুষ আসা কমে যায়। মাস দুয়েক প্রভাব ছিল। কিন্তু পুরনো যাদের ভিসা ছিল তারা ফিরে আসছে।

একজন হোটেল ও ট্যুরিজম ব্যবসায়ী জানান, এখন কিছুটা হলেও আমাদের ভাঁটা পড়েছে। কেন না, ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ আছে, যারা মেডিক্যাল ভিসায় আসছে, তারা টুকটাক আসছে। ট্যুরিস্ট ভিসা না থাকায় ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে। সর্বোচ্চ ২০ পারসেন্ট আসছে এখন, ৮০ পারসেন্ট ট্যুরিস্ট নেই। যারা আসছে তারাও মেডিক্যালের কাজ করে চলে যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট ভিসা হলে কেনাকাটা কিছুটা হয়।

ভিসা না দেওয়ার কারণ  
‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে ভারত আশ্বস্ত হচ্ছে না বলেই হয়তো’ এখনও ভিসা নিয়ে এমন কড়াকড়ি করছে দেশটি, এমনটাই মনে করছেন কূটনীতিকরা। 

ভিসা না দেওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব পড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে কূটনীতিকরা বলছেন, প্রভাব তো নেতিবাচক বটেই। ভিসা যদি না দেওয়া হয় তাহলে যাতায়াত কমে যায়। যাতায়াত কমা মানে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই নানান জটিলতায় পড়েন। দুই দেশের পিপল টু পিপল কানেক্টিভিটি যেটা ব্যাহত হয় নিশ্চিভাবেই।

আবার বাংলাদেশিরা দেশটিতে কম যাওয়ায় ভারতের স্থানীয় ব্যবসাও ক্ষতির মুখে পড়ে। কলকাতায় বাংলাদেশি ভিজিটরস না থাকার ফলে ট্যুরিজম বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। কলকাতার বিপণীবিতানগুলোর অবস্থা একটু চাপের মুখে আছে। তাতে করে স্থানীয় অর্থনীতির ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এটাতে লাভ কারোই হচ্ছে না। দুই দেশের মানুষ এতে করে এফেক্টেড হচ্ছে।

লাভ না হলেও ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের কঠোরতার কারণ কি কেবলই নিরাপত্তা না এর পেছনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও আছে, উঠছে এমন প্রশ্নও। তবে এক্ষেত্রে যদি নিরাপত্তার প্রসঙ্গ মুখ্য হয়ে ওঠে, তবে কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলেই মনে করেন সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিকরা।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ