ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে তুরস্কে বৈঠকে বসেছে ইউরোপীয় দেশগুলো। বৈঠকের অংশীদার হিসেবে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির (ইথ্রি) কর্মকর্তারা পরমাণু কর্মসূচির এই আলোচনায় ছিল। গতকাল শুক্রবার (১৬ মে) তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজেম ঘারিবাবাদী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলের এক পোস্টে জানান: “আমাদের পারমাণবিক আলোচনার সর্বশেষ অবস্থা এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে মতবিনিময় করেছি এবং আলোচনা করেছি।”
ঘারিবাবাদী আরও জানান, প্রয়োজনে তেহরান আবারও তথাকথিত ইথ্রি, চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ২০১৫ সালের চুক্তির ইউরোপীয় পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
বৈঠক প্রসঙ্গে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পলিটিক্যাল ডিরেক্টর ক্রিস্টিয়ান টার্নার সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম এক্স হ্যান্ডেলে বলেন, ইরান সংকট সমাধানে স্টেক হোল্ডাররা “সংলাপের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে, চলমান মার্কিন/ইরান আলোচনাকে স্বাগত জানিয়েছে ও জরুরি ভিত্তিতে আবার আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা জানান, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সাথে ইরান ও ইউক্রেন ইস্যুতে ইস্তাম্বুলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।

২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে ২০১৭ সালে আলোচনা করছেন ইউরোপীয় শক্তি ও ইরানি কূটনীতিকরা, ছবি: টাইমস অব ইসরায়েল
বৈঠকের আগে ইরানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, ২০১৫ সালের চুক্তির আওতায় জাতিসংঘের যে নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছিল, সেগুলো পুনর্বহাল করলে ‘অবর্ণনীয় পরিণতি’ ডেকে আনবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া এই তিন ইউরোপীয় দেশ সংক্ষেপে ‘ই-থ্রি’ নামে পরিচিত। তারা ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির সময় অন্যতম পক্ষ ছিল। বাকি অংশীদাররা হলো চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালে একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের ব্যাংকিং ও তেল খাতে পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
এর বছর খানেক পর ইরানও ধাপে ধাপে তাদের প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নেয়। ওই চুক্তির আওতায় ইরান নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তির বদলে জাতিসংঘ তত্ত্বাবধানে পরমাণু কার্যক্রম সীমিত রাখতে রাজি হয়। ইউরোপীয় দেশগুলো বর্তমানে চুক্তির ‘স্ন্যাপব্যাক’ ব্যবস্থাটি সক্রিয় করার বিষয়টি বিবেচনা করছে, যার ফলে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের পূর্বের নিষেধাজ্ঞাগুলা ফের কার্যকর হয়ে যাবে।
তবে এই ব্যবস্থা কার্যকরের সুযোগ আগামী অক্টোবরেই শেষ হয়ে যাবে। আরাগচি বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত ‘একটি বৈশ্বিক পারমাণবিক সংকট ডেকে আনতে পারে, যার প্রভাব ইউরোপের ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়বে।’ পাশাপাশি তিনি ফরাসি সাপ্তাহিক ‘লে পয়েন্ট’-এ এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইরান ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে প্রস্তুত।
ইউরোপীয় দেশগুলো বর্তমানে চুক্তির ‘স্ন্যাপব্যাক’ ব্যবস্থাটি সক্রিয় করার বিষয়টি বিবেচনা করছে, যার ফলে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের পূর্বের নিষেধাজ্ঞাগুলা ফের কার্যকর হয়ে যাবে। তবে এই ব্যবস্থা কার্যকরের সুযোগ আগামী অক্টোবরেই শেষ হয়ে যাবে।
আরাগচি বলেন, এই সিদ্ধান্ত ‘একটি বৈশ্বিক পারমাণবিক সংকট ডেকে আনতে পারে, যার প্রভাব ইউরোপের ওপরই সবচেয়ে বেশি পড়বে।’ তবে তিনি ফরাসি সাপ্তাহিক ‘লে পয়েন্ট’এ এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইরান ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে প্রস্তুত।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি ইউরোপীয়দের পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন, ছবি: দ্য অস্ট্রেলিয়ান
কয়েকদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যে চতুর্থ দফা পরমাণু আলোচনা শেষ হয়। ইরান সেই আলোচনাকে ‘কঠিন হলেও ফলপ্রসূ’ বলে উল্লেখ করে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, বৈঠকটি আশাব্যঞ্জক ছিল।
ওমানের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত ইরান-যুক্তরাষ্ট্র এই আলোচনা ছিল ২০১৮ সালে চুক্তি পরিত্যাগের পর দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংলাপ।
এদিকে কাতার সফরের সময় বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তির সময় ‘ঘনিয়ে আসছে’, যা সামরিক সংঘাত এড়াতে সহায়ক হবে।
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা ইরানে কোনো পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটতে দেব না।’
ক্ষমতায় ফিরে ট্রাম্প আবারো তার ‘সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের’ কৌশল চালু করেছেন। তিনি একদিকে কূটনৈতিক আলোচনার পক্ষে মত দিয়েছেন, অন্যদিকে ব্যর্থ হলে সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছেন।

তেহরানে সাবেক মার্কিন দূতাবাসের কাছে মার্কিনবিরোধী দেয়ালচিত্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক নারী, ছবি: ফ্রান্স২৪
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘এক্সিওস’ বৃহস্পতিবার জানায়, চতুর্থ দফা আলোচনার সময় ওয়াশিংটন ইরানকে একটি ‘লিখিত প্রস্তাব’ দিয়েছে। তবে আরাগচি এ দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা কিছুই পাইনি।’ তিনি বলেছেন, ‘আমরা পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে স্বচ্ছতা ও আস্থা তৈরিতে প্রস্তুত, যদি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।’
ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি ইরানের নেতৃত্বকে ‘অলিভ ব্রাঞ্চ’ বা শান্তির প্রতীকস্বরূপ প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই প্রস্তাব চিরকাল টিকে থাকবে না।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে আরো বলেছেন, আলোচনা ব্যর্থ হলে ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগ করা হবে এবং তেল রপ্তানি শূন্যে নামিয়ে আনা হবে।
জানা যায়, বর্তমানে ইরান ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা ২০১৫ সালের চুক্তিতে নির্ধারিত ৩.৬৭ শতাংশ সীমার অনেক ঊর্ধ্বে। যদিও তা পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার ৯০ শতাংশ নিচে।
তেহরান বলছে, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অধিকার তাদের রয়েছে এবং এটি কোনো আলোচনার বিষয় নয়। তবে তারা কতটা মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে, সেই বিষয়ে সাময়িক সীমাবদ্ধতা মানতে প্রস্তুত।
সূত্র:ফ্রান্স২৪, দ্য অস্ট্রেলিয়ান ও হিন্দুস্তান টাইমস