Home বিশ্ব ভারত-পাকিস্তান সংঘাত, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো যারা

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো যারা

৪১ views

তখনও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়নি। শনিবার (১০ মে) সকালে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বৃহত্তম শহর শ্রীনগরের ঝিলাম নদীর ঢালু বাঁধের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ফতেহ কাদালে ৬২ বছর বয়সী হাজিরা নিজ কাঁধে বাদামী রঙের পেসলি ডিজাইনের একটি সুতির স্কার্ফ জড়িয়ে এসেছেন রেশন নিতে।

মুখের পেশী টানটান এবং উপরের ঠোঁটে ঘাম জমে থাকা অবস্থায়, তিনি একটি সরকার পরিচালিত শস্যের দোকানের সিমেন্টের মেঝেতে বসে আছেন। এক পর্যায়ে দোকানদারকে ডেকে বললেন, “তুমি কি তাড়াতাড়ি করতে পারো?”

হাজিরা প্রতি মাসে এই দোকানে আসেন তার বায়োমেট্রিক তথ্য জমা দেওয়ার জন্য। এর মাধ্যমে সরকারের নির্দেশ অনুসারে, তার চার সদস্যের পরিবার ভর্তুকিযুক্ত পণ্য পান। কিন্তু এবারের সময়টি ভিন্ন। ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জন্য গত কয়েক দিন নজিরবিহীন। মাথার উপরে ড্রোন উড়ছে, বিমানবন্দর বন্ধ, কিছুক্ষণ পরপর বিস্ফোরণের শব্দ সবমিলিয়ে অনিশ্চিত এক জীবন। সীমান্তে গুলিবর্ষণে মানুষের মৃত্যুর পর অঞ্চলটি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত ছিল।

দোকানের অপারেটরের দিকে ইঙ্গিত করে হাজিরা বললেন, “সে আমাকে লাইনে দাঁড় করিয়েছে, কিন্তু চারপাশে অনিশ্চয়তা। আমি শুধু আমার ভাগের পণ্যগুলো চাই, যাতে আমি দ্রুত ফিরে আসতে পারি। যুদ্ধ আসছে।”

অবশ্য শনিবার সন্ধ্যায়, হাজিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এদিন ঘোষণা করলেন যে তিনি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করতে সফল হয়েছেন।

হাজিরা লজ্জার সাথে হেসে বললেন, “আমি এর জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির ফলে যে আর্থিক কষ্ট হতো তা সহ্য করার মতো সামর্থ্য আমার নেই।”

গতকাল রোববার সকালে, ট্রাম্প আরও এক ধাপ এগিয়ে তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে একটি পোস্টে বলেছেন যে কাশ্মীর নিয়ে তাদের দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ সমাধানের জন্য ভারত -পাকিস্তান বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করা হবে। কাশ্মীর এমন একটি অঞ্চল যা উভয় দেশ আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই পুরো অংশ নিজেদের দাবি করে আসছে।

ভারত-শাসিত কাশ্মীরের জম্মু শহরে অবস্থিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাফর চৌধুরী আল জাজিরাকে বলেছেন, ট্রাম্পের বক্তব্যে নয়াদিল্লি খুশি হবে না। ভারত দীর্ঘদিন ধরে যুক্তি দিয়ে আসছে যে পাকিস্তান “সন্ত্রাসবাদ”কে মদদ দিচ্ছে, যা পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীদের মধ্যে উত্তেজনার প্রধান কারণ। তবে, “ট্রাম্পের প্রস্তাব এই সত্যকে তুলে ধরে যে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে কাশ্মীর রয়ে গেছে।”

‘আর কখনও এত ভীত হইনি’
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের রেখায় লাখ লাখ কাশ্মীরি দাঁড়িয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশগুলো একে অপরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপ করেছে। পাকিস্তানের সাথে থাকা সীমান্তের কাছে গোলাবর্ষণ দেখা গেছে, যার ফলে মানুষ নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় চার দশক ধরে সংঘাতের ছায়া কাশ্মীরিদের জীবনকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ২০১৯ সালে মোদি সরকার বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করে দেয়। পরে হাজার হাজার মানুষকে কারারুদ্ধ করে ভারত।

গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে পর্যটকদের উপর বন্দুকধারীদের এক নৃশংস হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। তারপর থেকে, পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক প্রতিশোধ এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পাশাপাশি, ভারত সরকার ভারত-শাসিত কাশ্মীরের উপর তার কঠোর ব্যবস্থা তীব্রতর করেছে।

তারা পেহেলগাম হামলার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বিদ্রোহীদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ওই অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালিয়ে প্রায় দুই হাজার ৮০০ জনকে আটক করেছে, যাদের মধ্যে ৯০ জনের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা আইনের ( কঠোর প্রতিরোধমূলক আটক আইন) অধীনে মামলা করা হয়েছে। পুলিশ অনেক সাংবাদিককেও তলব করেছে এবং “বিচ্ছিন্নতাবাদী মতাদর্শ প্রচারের” জন্য কমপক্ষে একজনকে আটক করেছে।

রোববার পর্যন্ত, যুদ্ধবিরতি নিয়ে এই অঞ্চলে আনন্দের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লেও, ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি টিকবে কিনা তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত ছিলেন, এমনকি সন্দেহও প্রকাশ করেছিলেন। উভয় দেশ শত্রুতা বন্ধ ঘোষণা করার কয়েক ঘন্টা পরেই, ভারত-শাসিত কাশ্মীরের প্রধান শহরাঞ্চলগুলোতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা ড্রোনগুলো ভূপাতিত করার ভিডিও ধারণ করার জন্য অনেক বাসিন্দা তাদের অ্যাপার্টমেন্ট এবং বাড়ির ছাদে ছুটে গিয়েছিলেন। মধ্য আকাশে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে রাতের আকাশে উজ্জ্বল লাল বিন্দুর চিহ্ন তারা দেখেছেন।

জরুরি প্রোটোকলের অংশ হিসেবে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ তাদের উপর পড়তে পারে এই ভয়ে, বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে গেছেন। রাতের আকাশে ড্রোনের কারণে সাইরেনও বেজে ওঠে, যার ফলে বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

শ্রীনগরের ২৪ বছর বয়সী হাসনাইন শাবির বলেন, “আমার মনে হয় না আমি এর আগে কখনও এত ভীত ছিলাম, রাস্তাঘাট তাদের জীবনের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। যুদ্ধের পূর্বাভাস যদি এমন দেখায়, তাহলে আমি জানি না যুদ্ধ কেমন হবে।”

ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি
শনিবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কয়েক ঘন্টা পরে ভারত অভিযোগ করেছে, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে সীমান্ত অঞ্চলে গোলাবর্ষণ করেছে পাকিস্তান। এছাড়া আকাশে পুনরায় ড্রোন দেখা যাওয়ার পর কাশ্মীরের প্রধান শহরগুলোর বাসিন্দারা আবারও সতর্ক হয়ে যান।

কাশ্মীরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলির মধ্যে একটি হল উরি। ভারত-পাকিস্তানের বিরোধপূর্ণ সীমান্তের কাছে নাশপাতি বাগান এবং আখরোটের বাগানের একটি মনোরম শহর এটি। গ্রামটি রাজকীয় পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত যার মধ্য দিয়ে ঝিলাম নদী প্রবাহিত হয়েছে। পাহাড়গুলো পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে যাওয়ার পথ তৈরি করার আগে, ভারত-শাসিত দিকের শেষ সীমান্ত।

এবারের সংঘাতের সময় উরির কিছু অংশে তীব্র গোলাবর্ষণ দেখা গেছে। যার ফলে বাসিন্দারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। ৮ মে কর্মকর্তারা আল জাজিরাকে জানান যে, নার্গিস বশির নামে এক মহিলা তার গাড়িতে নিহত হয়েছেন। তখন তিনি এবং তার পরিবার সীমান্ত অঞ্চল থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু শ্যাপারনেল উড়ে গাড়িতে পড়লে তার পরিবারের তিন সদস্য আহত হন।

৬০ বছর বয়সী সাবেক সেনা সদস্য মুহাম্মদ নাসির খান তার ঘরে বসে ছিলেন। ঠিক তখনই পাকিস্তানি কামানের গোলা কাছাকাছি একটি সামরিক পোস্টে আঘাত হানে, ধাতব শ্যাপারনেল শাওয়ারের টুকরো তার বাড়ির দেয়াল ভেদ করে বিস্ফোরিত হয়। তিনি বলেন, “বিস্ফোরণে আমার বাড়ির একপাশে ক্ষতি হয়েছে”।

সাবেক এই সেনা সদস্য বলেন, “আমি জানি না এই জায়গাটি বসবাসের যোগ্য কিনা,” এই কথা বলার সময় তার উজ্জ্বল নীল চোখে ভয়ের অনুভূতি ছিল। যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও, তার দুই মেয়ে এবং তার পরিবারের আরও অনেকে সীমান্ত থেকে দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন, তারা ফিরে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমার সন্তানরা ফিরে আসতে চাচ্ছে না। বন্দুক আবার গর্জন করবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই”।

উরির বাসিন্দা ২৮ বছর বয়সী সুলেমান শেখ তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন তার দাদু মোহরা গ্রামের কাছের একটি সামরিক গ্যারিসনের ভেতরে থাকা বোফর্স আর্টিলারি বন্দুকের কথা বলতেন। শেখের কথায়, “তিনি আমাদের বলেছিলেন যে এই বন্দুকটি শেষবার গর্জে উঠেছিল ১৯৯৯ সালে, যখন ভারত-পাকিস্তান কার্গিলের বরফাচ্ছাদিত চূড়ায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এখানে প্রচলিত বিশ্বাস, যদি এই বন্দুকটি আবার গর্জে ওঠে, তাহলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যাবে”।

৮ মে রাত ২টায় এমনটাই ঘটেছিল। মোহরায় বোফর্স বন্দুকটি যখন পাহাড় পেরিয়ে পাকিস্তানে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন শেখ অনুভব করলেন, তার পায়ের নীচের মাটি কাঁপছে। দেড় ঘন্টা পরে, অপর দিক থেকে ছোড়া একটি গোলা কাছাকাছি একটি ভারতীয় আধাসামরিক স্থাপনায় আঘাত করে।

এই প্রতিবেদনের জন্য শেখ আল জাজিরার সাথে কথা বলার কয়েক ঘন্টা পরে, আরেকটি গোলা তার বাড়িতে এসে পড়ে। আল জাজিরার সাথে শেয়ার করা একটি ভিডিও অনুসারে, এতে তার বাড়ির ঘর এবং বারান্দা ভেঙে পড়ে। তার পরিবারের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি বাড়ি ছেড়ে যাননি। তার কথায়, “আমি আমাদের গবাদি পশুদের রক্ষা করার জন্য এখানে এসেছিলাম, তাদের একা ছেড়ে যেতে চাইনি।”

কাশ্মীর উপত্যকার বাকি অংশের মানুষ আপেল চাষ এই অঞ্চলের জন্য লাখ লাখ ডলার আয় করে। তবে উরি তুলনামূলকভাবে দরিদ্র। গ্রামবাসীরা বেশিরভাগই ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য ছোটখাটো কাজ করে অথবা আখরোট এবং নাশপাতি চাষ করে। পশুপালন শহরের অনেকের কাছে একটি জনপ্রিয় পেশায় পরিণত হয়েছে।

শেখ বলেন, “যুদ্ধ কেমন লাগে তার অভিজ্ঞতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। যুদ্ধবিরতি হয়েছে তা ভালো। কিন্তু আমি জানি না এটি টিকবে কি না,” শেখের মুখ বিষণ্ণ। তিনি বলেন, “আমি প্রার্থনা করি এটি যেন থাকে।”

‘এটি কতক্ষণ চলতে থাকবে?’
শ্রীনগরে ফিরে, বাসিন্দারা ধীরে ধীরে তাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দে ফিরছেন। স্কুল এবং কলেজ বন্ধ রয়েছে এবং বাসিন্দারা অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে চলছেন। আকাশে ড্রোন বহরের দৌড় এবং তার সাথে বিস্ফোরণের দৃশ্য জনসাধারণের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে।

রাতারাতি যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে, সেটি স্থায়ী হবে কিনা তা নিয়ে উত্তেজনা রয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে সাধারণ সন্দেহের কারণ হিসেবে এই অঞ্চলের অমীমাংসিত রাজনৈতিক সমস্যাগুলিকে দায়ী করেছেন। রোববার ট্রাম্পের বিবৃতিতেও এই বিষয়টি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যেখানে তিনি “কাশ্মীর সম্পর্কিত সমাধান”-এর সম্ভাব্য কথা উল্লেখ করেছিলেন।

কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান নূর আহমেদ বাবা বলেন, “শুরুতেই সমস্যাটি হল (কাশ্মীরিদের) রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। গত কয়েক বছরে তাদের সাথে যা ঘটেছে তার জন্য কাশ্মীরের মানুষ অপমানিত বোধ করে এবং তাদের মন জয় করার জন্য কোনও উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা করা হয়নি। যখন অপমান হয়, তখন সন্দেহ তৈরি হয়।”

ভারত-শাসিত কাশ্মীরের অন্যরা তাদের জীবন নষ্ট করার জন্য উভয় দেশের প্রতি তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ফুরকান নামের একজন বলেন, “আমি সন্দেহ করি যে কাশ্মীরি হিসেবে আমাদের অনুভূতির কোনও গুরুত্ব নেই”।

সূত্র: এক্সপ্রেস ট্রিবিউন

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ