যুদ্ধ ও দুর্যোগকালে যারা মানবিক সহায়তা করেন তাদের বীর আখ্যা দিয়ে প্রশংসা করেছেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যারা উদার তাদের জয়গান গেয়ে মানবতার সেতুবন্ধন তৈরির আহবান জানান তিনি। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ব্রিটেনের ডারহাম ক্যাথেড্রালে ঐতিহ্যবাহী মাউন্ডি সার্ভিসে যোগ দেয়ার আগে ইস্টার সান ডে উপলক্ষ্যে এক বার্তায় এসব কথা বলেন তিনি।
রাজা চালর্সের সঙ্গে রাণী ক্যামিলাও সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। অনুষ্ঠানে রাজা বিশেষভাবে তৈরি ব্রিটিশ মুদ্রা মাউন্ডি মানি ৭৬ জন পুরুষ ও নারীকে প্রদান করবেন। রাজার বয়সের সঙ্গে মিল রেখেই এবার মাউন্ডি মানি প্রদান করা হচ্ছে। আগামী রোববার (২০ এপ্রিল) ইস্টার সান ডে।
রাজার বার্তায় যীশুর নম্রতার কথা বলেছেন। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে যীশু খ্রিস্টের শান্তির বাণীর মতো ইহুদি ও ইসলাম ধর্মের সদ্ব্যবহারেরও প্রশংসা করেন তিনি। ইস্টারের বার্তায় রাজা “মানব জীবনের জটিলতা” সম্পর্কে কথা বলেছেন। সেখানে মানবতাবাদী কর্মীদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
জরুরি অবস্থা ও যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যদের সাহায্য করার জন্য যারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নেন তাদের সম্মানে একটি নতুন মানবিক পদক চালু করা হয়েছে এবং রাজা তাদের নিঃস্বার্থতা ও মানবতার প্রশংসা করেছেন।
ইস্টার বার্তায় রাজা বলেন, “পৃথিবীর এখনও বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা এই তিনটি গুণের প্রয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো ভালোবাসা। অন্যদের মঙ্গল কামনা করে এমন সব ধর্মের মানুষের জন্য মূল বার্তা হল অন্যদের প্রতি ভালোবাসা।

ব্রিটিশ রাজা চার্লস ও রাণী ক্যামিলা, ছবি: দ্য টাইমস
রাজা চার্লস একজন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। প্রাসাদের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত সপ্তাহে ইতালিতে সফরে রাভেনায় তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখেন। এতে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
ক্যান্সারের চিকিৎসার কারণে রাজা চার্লস গত বছরের মাউন্ডি উপাসনায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তার পক্ষ থেকে রাণী ক্যামিলা মাউন্ডি অর্থ প্রদান করেছিলেন।
এই বছরের মাউন্ডি মুদ্রায় চালর্সের মা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্মরণে ৫ পাউন্ড ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মরণে আর ৫০ পেন্স মূল্যের একটি মুদ্রা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। স্থানীয় গির্জা ও অসহায়দের সাহায্য করেছেন এমন ব্যক্তিরা এসব রাজার পক্ষ থেকে এসব উপহারের মুদ্রা পাবেন।
এটি প্রাচীনতম রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। ১৩ শতক ও রাজা জনের রাজত্বকাল পর্যন্ত চলে আসছে। অন্যান্য বছর আরও বেশি মানুষকে এই উপহার প্রদান করা হলেও এবার রাজার বয়সের সঙ্গে মিল রেখে ৭৬ জনকে দেয়া হবে।
আগামী রোববার (২০ এপ্রিল) ইস্টার উদযাপন করতে যাচ্ছেন ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উৎসবটি যিশুর মৃত্যু ও তার পুনরুত্থানকে স্মরণ করে শতাব্দী প্রাচীন রীতিনীতির মাধ্যমে উদযাপিত হয়।

ঐতিহাসিক ডারহাম ক্যাথাডাল ভবন, ছবি: ব্রিটানিকা
ইস্টারের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। বসন্তকালীন পূর্ণিমার পরবর্তী রোববারেই এই দিনটি পালন করা হয়। এর আগে আসে ৪০ দিনের উপবাস ও প্রার্থনার সময় যীশুর মরুভূমিতে কাটানো সময়ের স্মরণে ‘লেন্ট’ পালন করা হয়।
‘হলি উইক’ শুরু হয় ‘পাম সানডে’ দিয়ে, যা প্রায় ২,০০০ বছর আগে যীশুর জেরুজালেমে প্রবেশ ও ইহুদি পাসওভার উৎসবে অংশগ্রহণকে স্মরণ করে।
‘মাউন্ডি থার্সডে’ পালিত হয় যিশুর শেষ আহার ‘লাস্ট সাপার’-এর স্মরণে। এই সময় তিনি তার ১২ শিষ্যের সঙ্গে আহার করেন এবং মানবজাতির মুক্তির জন্য নিজের দেহ ও রক্ত উৎসর্গ করেন বলে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস। এরপর যিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়, জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে রোমান সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। ‘গুড ফ্রাইডে’ পালন করা হয় যিশুর ‘প্যাশন’ বা দুর্ভোগ ও ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার স্মরণে।
খ্রিস্টান মতে, যীশুকে ইহুদি নেতারা ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবি করায় মিথ্যাচারের অভিযোগে এবং রোমানরা তাকে জনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। পরে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়।

ইস্টার উদযাপনের প্রস্তুতিতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়, ছবি: দ্য স্টেট জার্নাল রেজিস্ট্রার্ড
বিশ্বাস করা হয়, যিশু বিকেল তিনটায় মারা যান। এরপর তাকে ক্রুশ থেকে নামিয়ে কাপড়ে জড়িয়ে সমাধিতে রাখা হয়। এই দুর্ভোগের স্মরণে রোমের আলো-আলোকিত কলোসিয়ামে সন্ধ্যাকালীন ‘স্টেশন অব দ্য ক্রস’ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
‘হলি স্যাটারডে’ হলো শোক ও নীরবতার দিন। এই দিন শেষ হয় ‘ইস্টার ভিজিল’-এর মধ্য দিয়ে, যেখানে যিশুর মৃত্যু জয়ের প্রতীক হিসেবে ‘পাসকাল ক্যান্ডেল’ প্রজ্বলন করে পুনরুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী, এই ভিজিলেই প্রতিবছর প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যাপটিজম অনুষ্ঠিত হয়।
ব্যাপটিজম খ্রিষ্টানদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যেখানে কোনো ব্যক্তিকে পবিত্র পানিতে অভিসিঞ্চিত বা নিমজ্জিত করে খ্রিষ্টীয় ধর্মসংঘের সদস্য করে নেওয়া হয়।
‘ইস্টার সানডে’ উদযাপন করা হয় যীশুর পুনরুত্থানকে কেন্দ্র করে। যিশুর অনুসারী মেরি ম্যাগডালেন তার কবর পরিদর্শনে গেলে দেখতে পান, কবরের প্রবেশপথে রক্ষিত পাথর সরে গেছে এবং যিশুর দেহ সেখানে নেই।
ইস্টার উদযাপন নানা ঐতিহ্যের মাধ্যমে পালিত হয়: ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে তিন দিনের শোকের পর আনন্দের প্রত্যাবর্তন বোঝানো হয়; আর ডিম সাজানোর রীতি, যা জীবন ও পুনর্জন্মের প্রতীক, তার শিকড় বহু প্রাচীন কালে।
ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টরা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে একই দিনে ইস্টার উদযাপন করেন। অপরদিকে অর্থোডক্স চার্চ জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। এ বছর দুটি বর্ষপঞ্জির হিসাব মিলেছে, যা খুবই বিরল ঘটনা।
সূত্র: ইয়াহু নিউজ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য স্ট্যান্ডার্ড