Home টপ পোস্ট দুটি ছাড়া অর্থনীতির সব সূচক নিম্নমুখী

দুটি ছাড়া অর্থনীতির সব সূচক নিম্নমুখী

ইকবাল হোসেন
১৬৬ views
অর্থনীতির সূচক

দুটি সূচক বাদে অর্থনীতির প্রায় সব সূচক এখন নিম্নমুখী। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় রয়েছে, এতে মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি রয়েছে। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমদানিতে ভাটা চলছে। এম অবস্থার মধ্যে স্বস্তির সূচক হচ্ছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতির আর কোনো সূচকই ভালো অবস্থানে নেই।

বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক। অনেক ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) নেমে এসেছে। নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। ফলে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে। টানা দরপতনে ডুবতে বসেছে শেয়ারবাজার।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১০ আগস্ট বলেছিলেন, বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। আমাদের লক্ষ্য হবে অর্থনীতিকে যত দ্রুত সম্ভব গতিশীল করা। কারণ, অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে গেলে সেটা চালু হওয়া বেশ কঠিন। আমরা অর্থনীতিকে স্তব্ধ হতে দিতে চাই না। তবে গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তিনি বলেছেন, দেশীয় শিল্পের বিকাশে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি
সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে অবস্থান করছে। আগের মাস আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল।

গত অর্থবছর (২০২৩-২৪) ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে শেষ হয়েছিল। গত অর্থবছরের  সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল  ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ ছিল।

নিত্যপণ্য

সেপ্টেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১০.৪০ শতাংশে দাঁডিয়েছে

সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই বছরের সেপ্টেম্বরে সেই পণ্য বা সেবা পেতে ১০৯ টাকা ৯২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে
বিবিএসের তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে দেশের শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৫৫ গুণ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। সে হিসাবে গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের চেয়ে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫৭ গুণ কমেছে।

সরকারের আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এই খাতে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্পখাতের হিস্যা যখন ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, তখন এই খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমেছে
পরিসংখ্যান ব্যুরো গত সোমবার গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) চতুর্থ বা শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, এপ্রিল-জুন সময়ে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চার প্রান্তিকের মধ্যে সবচেয়ে কম এবং আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকের প্রায় অর্ধেক।

২০২২-২৩ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে দেশে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। মূলত শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধিতে ধসের কারণেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কয়েক দিন আগে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ বলেছে, ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। এডিবি বলেছে, ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল ‍বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকার।

এফডিআই কমেছে ৮.৮ শতাংশ
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নেট ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ৮.৮ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত মঙ্গলবার প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১.৬১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেট এফডিআই প্রবাহ ১.৪৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই প্রবাহ ১৪২ মিলিয়ন ডলার কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দেশে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কম। আয় ফেরত নেওয়ার ভোগান্তি, অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এফডিআই কমেছে বলে জানিয়েছে বিশ্লেষকরা।  

এদিকে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট), ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।

রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, এই তিন মাসে সার্বিকভাবে শুল্ক ও কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর।

এনবিআরের হিসাব অনুসারে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে ৭৫ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে এই তিন মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।

রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবরেও প্রবাসী আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা প্রায় ২৮ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে)। গত বছরের অক্টোবরে দেশে এসেছিল ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয়। ফলে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ।

রিজার্ভ

অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ছবি: ফ্রিপিক ডটকম

গত সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ডলারের আয় এসেছিল, যা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি এবং মাস ভিত্তিতে এ বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আগের মাস, অর্থাৎ আগস্টে প্রবাসী আয় আসে ২২২ কোটি ডলার। চলতি বছরে সর্বোচ্চ ২৫৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসে জুন মাসে। সেটিই একক মাসের হিসাবে গত তিন বছরে মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়। এর আগে সর্বোচ্চ আয় এসেছিল ২০২০ সালের জুলাইয়ে, ২৫৯ কোটি ডলার। প্রবাসী আয়সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি
রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এরপর চার মাস কোনো রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেনি ব্যুরো। গত ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে চার মাসের তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করেন ইপিবির।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ১৩৭ কোটি (১১.৩৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই আয়ের অঙ্ক ছিল ১ হাজার ৮২ কোটি (১০.৮২ বিলিয়ন) ডলার। তবে চলমান অস্থিরতার মধ্যে আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন রপ্তানিকারকরা।

রিজার্ভের পতন থামছে না
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়লেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। গত ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ৩০ অক্টোবর রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। দুই সপ্তাহ আগে ১৬ অক্টোবর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ৬ কোটি ডলার। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের বিল পরিশোধ করতে হবে, তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

আমদানি কমছেই
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, এই তিন মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ১ হাজার ৫৫৯ কোটি ১১ লাখ (১৫.৫৯ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। নিস্পত্তি কমেছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ।

জুলাই-সেপ্টেম্বরে এলসি খোলার হার ৬.৭৪ শতাংশ কমেছে। ছবি: ফ্রীপিক ডটকম

২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৬ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ, নিস্পত্তি কমেছে ২৫ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ, নিস্পত্তি কমেছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানির এলসি কমেছে ২৬ শতাংশ, নিষ্পত্তি কমেছে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। এই তিন মাসে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বিদেশি ঋণ প্রাপ্তির চেয়ে পরিশোধ বেশি
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। কিন্তু সেই ঋণের এক ডলারও এখনও দেশে আসেনি। এরই মধ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তিন মাস (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) পার হয়ে গছে। এই তিন মাসে বিদেশি ঋণ প্রাপ্তির অবস্থা খুবই খারাপ। যে ঋণ পাওয়া গেছে, তারচেয়ে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ অনেক বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, এই তিন মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মাত্র ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে আগে পাওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১১২ কোটি ৬৫ লাখ (১.১৩ বিলিয়ন) ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যতো ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে তার চেয়ে ২৮ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, গত  দু’বছরের নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ সংকটে রয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে সরকারকে অর্থনৈতিক কূটনীতি কাজে লাগাতে হবে।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে কেবল মুদ্রানীতিই নয়, রাজস্ব নীতির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান, বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, মধ্যসত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তথ্য-উপাত্তের বিভ্রান্তি কাটিয়ে সঠিক তথ্য প্রদান নিশ্চিত করা যাতে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সহজ হয়। এসব দিকগুলোতে আমাদের জরুরি নজর দিতে হবে। কতটুকু আমদানি, কতটুকু উৎপাদন ও সরবরাহ, চাহিদা কতটুকু— তার ভিত্তিতে বাজার ব্যবস্থাপনা, আমদানি এবং স্টক থেকে রিলিজ করা— এগুলোর দিকেও আমাদের নজর দিয়ে গত দু’বছরের অর্থনৈতিক সংকটকে সামাল দিতে হবে। সরবরাহ চেইনে যেসব বিচ্যুতি ছিল সেগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি এবং যেসব নেতিবাচক প্রবণতা ছিল সেগুলোকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এসবই তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের মধ্যে পড়েব।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের শুল্ক ছাড় দিতে পারে সরকার। আমদানির ক্ষেত্রে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী একচেটিয়া প্রভাব ফেলে বাজারে। এসব মোকাবেলায় আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বাড়ানো প্রয়োজন। যদিও এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ