বৈশ্বিক কর্মশক্তি বিভিন্ন স্তরে চাপের সম্মুখীন, কিছু দেশে অন্যদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কাজের সময় অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি কাজ করা দেশগুলোর মধ্যে ভারত, ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের অবস্থান কর্মচারীদের সুস্থতা, উৎপাদনশীলতা এবং কর্মজীবনের ভারসাম্য নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভারতের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও উচ্চ চাপের জন্য বিশ্বে সমালোচিত। এশিয়ার অধিকাংশ দেশই সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করার আন্তর্জাতিক নিয়ম মানছে না।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তালিকাটি তৈরিতে ২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত প্রতিটি দেশের সর্বশেষ বার্ষিক তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ভারত বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি কাজ করা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। একজন ভারতীয় কর্মচারী প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫৬ ঘণ্টা কাজ করে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশি কৰ্মীরা সপ্তাহে গড়ে ৫০ দশমিক ৪ ঘণ্টা কাজ করে। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ ভুটান। দেশটির একজন কর্মচারী প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫৩ দশমিক ৩ ঘণ্টা কাজ করে।
আইএলওর ১৮৭ দেশের তালিকায় শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে আরো রয়েছে উগান্ডা (৪র্থ, ৫০ দশমিক ৩ ঘণ্টা), কম্বোডিয়া (৫ম, ৪৯ দশমিক ৫ ঘন্টা), পাকিস্তান (৬ষ্ঠ, ৪৯ দশমিক ২ ঘণ্টা), সুদান (৭ম, ৪৯ ঘন্টা), আরব আমিরাত (৮ম, ৪৮ দশমিক ৭ ঘন্টা, জর্ডান (৯ম, ৪৮ দশমিক ৪ ঘন্টা) ও জিম্বাবুয়ে (১০ম, ৪৮ দশমিক ১ ঘন্টা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত কর্মঘণ্টা উপযুক্ত কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কর্মীদের আয়, সুস্থতা ও জীবনযাত্রার অবস্থার উপর বড় প্রভাব ফেলে। কাজের সময় সংক্রান্ত কিছু প্রধান চ্যালেঞ্জ শিল্প যুগের শুরু থেকেই রয়ে গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে কম সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টার শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে নেদারল্যান্ডস (২৯.৮ ঘন্টা), রুয়ান্ডা (২৯.৯), ইরাক (৩১.৬), অস্ট্রিয়া (৩২.৪), ডেনমার্ক (৩২.৬), নরওয়ে (৩৩), জার্মানি (৩৩.৫) ও ফিনল্যান্ড (৩৩.৫)
আইএলওর তথ্য অনুসারে, সারা বিশ্বে শ্রমিকরা সপ্তাহে গড়ে ৪৩ দশমিক ৯ ঘন্টা কাজ করেন। গড় কর্মঘণ্টার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে, যার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক নিয়ম, অর্থনৈতিক কাঠামো ও শ্রম নীতির তারতম্য প্রতিফলিত হয়।
প্রতিবেদনে ভারতের কর্পোরেট কাজের সংস্কৃতিকে ‘বিষাক্ত’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ভারতের অন্যতম বৃহত্তম প্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তরুণদের সপ্তাহে ৭০ ঘন্টা কাজ করা উচিত।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং গ্রুপের ২৬ বছরের একজন ইন্টার্ন হিসাবরক্ষক কাজের চাপের কারণে মারা গিয়েছিলেন। এ মৃত্যু ভারতে কর্মক্ষেত্রে অবস্থার বিষয়ে জাতীয় তদন্তের সূত্রপাত করেছিল এবং দেশটির কর্পোরেট সেক্টরে বিষাক্ত কাজের সংস্কৃতি সম্পর্কে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছিল।
স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, উৎপাদনশীলতা ও কর্মজীবনের ভারসাম্যের উপর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে প্রতি সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি কাজ করাকে আইএলওর মানদণ্ডের অতিরিক্ত বলে মনে করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সপ্তাহে যারা ৪৮ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করেন, তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ বেশি হয়। হার্টের অন্যান্য ব্যাধিতেও মৃত্যুর হার ১৭ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া অতিরিক্ত কাজের চাপে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, আর্থারাইটিস, ক্রনিক লাং ডিজিজ এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। অতিরিক্ত কাজ, মানসিক চাপ, ক্লান্তিভাব আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়তে পারে। জাপানে যেখানে কর্মীরা ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করেই অভ্যস্ত, তারা অনেক সময়ই কাজের চাপে বাড়ি যান না। অফিসের আশেপাশেই কোনও ক্যাফে বা স্লিপিং পডে ঘুমান। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার অফিস চলে যান। কাজের চাপে মানসিক অবসাদ ও তার জেরে আত্মহত্যা- জাপানে এখন বড় ব্যাধির আকার নিয়েছে, যাকে বলা হয় কারোজিসাতসু। মনোবিদদের আশঙ্কা, ভারতেও ধীরে ধীরে রোগের আকার নিচ্ছে এই আত্মহত্যা প্রবণতা।