দেশে ভোজ্যতেলের প্রায় ৯০ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এরমধ্যে মূলত সয়াবিন ও পামঅয়েলই বেশি আমদানি হয়। দেশে বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজারে ১১টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপ আমদানি করা ভোজ্যতেলের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ লাখ সাত হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি করা হয়। এর ৮০ শতাংশই এই চার প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। মাত্র ১০ বছর আগে এই চার প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় এক চতুর্থাংশ পূরণ করতো। বাজারে তাদের সম্মিলিত অংশীদারিত্ব এখন বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।
দেশে ভোজ্যতেলের বেশিরভাগ যোগান আসে আমদানি করা সয়াবিন ও পামঅয়েল থেকে। বাকিটা সরিষা, সানফ্লাওয়ার অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েলসহ অন্যান্য উৎস থেকে আসে। এই বিকল্পগুলো থেকে সম্মিলিতভাবে বছরজুড়ে তেল পাওয়া যায় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন। গত ২ বছর দেশে সরিষার তেলের উৎপাদন দুইগুণ বেড়েছে। সরিষা ও সয়াবিন তেলের দাম প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তারা সরিষা তেল ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে ভোজ্যতেলের যে চাহিদা রয়েছে আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে সেই চাহিদার ৪০-৫০ শতাংশ মেটানো হবে সরিষার তেল দিয়ে। আর এই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গত বছর থেকেই সরিষার চাষ বাড়ানোর জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

সয়াবিন তেল। ছবি: ফ্রীপিক
বাজার যাদের নিয়ন্ত্রণে
গত এক দশকে দেশে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক তৃতীয়াংশ কমেছে। বিশ্ববাজারে দামের অস্থিতিশীলতা ও সরকারের নীতির কারণে অনেকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেননি। ২০০৮ ও ২০১২ সালে বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দামের অস্থিরতার কারণে অনেক আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীর ব্যাপক ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমদানি খরচের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করলে সমস্যার শুরু হয়। ফলে ৩২টি দেশীয় ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে নূরজাহান গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, ইলিয়াছ ব্রাদার্স ও মোস্তফা গ্রুপসহ অর্ধ ডজনেরও বেশি প্রধান ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই শিল্পে বিপর্যয় দেখা দেয়। ঋণখেলাপি ও অন্যান্য কারণে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও অতিরিক্ত মুনাফার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন টি কে গ্রুপের সিনিয়র বিপণন সাইদুর রহমান। তিনি হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ নেই। সরকারের সংস্থাগুলো সার্বক্ষণিক বাজার নজরদারিতে রাখছে। সরকারি নীতির কারণে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, আমরা খোলা বাজার থেকে তেল কিনি। সেখানে সকালে এক দাম এবং বিকেলে আরেক দাম। কিন্তু নানান সময় সরকার আমাদের নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেলের ব্যবসা থেকে সরে গেছে।
ভোজ্যতেলের বাজারে টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের বড় ভূমিকা আছে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সরে যাওয়ার সুযোগে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অবস্থান শক্ত করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (বিইওএল), বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস, স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস, সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, গ্লোব, ডেল্টা এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজসহ কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠান বাজারে এলেও তারা এখনও বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, বাজার মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। শীর্ষ ব্যবসায়ীরা পণ্যের দামকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন যা ক্রেতাদের স্বার্থকে প্রভাবিত করে।
ক্যাব সভাপতির মতে, সব প্রতিষ্ঠান বাজারে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করলে ক্রেতারাও উপকৃত হবেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে ক্রেতার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে সরকারের ভূমিকা জরুরি।

পামঅয়েল। ছবি: ফ্রিপিক
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা। আর পাম তেলের লিটারপ্রতি দাম ১৬২-১৬৩ টাকা। সেখানে বাজারে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৬৫-১৬৭ টাকা। গত এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম ১১ শতাংশ ও পাম তেলের দাম সাড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দেশেও পণ্যটির দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয় ২০২১ সাল থেকে থেকে। ২০২২ ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায় বিশ্বাবাজারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২১ সালে গড়ে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৩৮৫ ডলার দরে। ২০২২ সালে প্রতি টনের গড় দাম ছিল ১ হাজার ৬৬৭ ডলারে। চলতি বছরের অক্টোবরে টন প্রতি সয়াবিন তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৫ ডলার। একইভাবে ২০২১ সালে পাম তেলের গড় দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ১৩১ ডলার। ২০২২ সালে একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে টনপ্রতি ১ হাজার ২৭৬ ডলার। চলতি বছরের অক্টোবরে টনপ্রতি পাম তেলের মূল্য দাঁড়িয়েছে হয়েছে ১ হাজার ৭৭ ডলার।
গত দুই দশকে দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৩০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, পাম ও সয়াবিন তেল পরিশোধিত ও অপরিশোধিত আকারে আমদানি হয়। অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করা সয়াবিন তেল স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়। তবে দেশের বাজারে ব্যবহার ও আমদানি বেশি হয় প্রধানত পরিশোধিত পাম অয়েল। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। আর ১৩ লাখ টন পাম তেল আমদানির ৯০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাকি ১০ শতাংশ আমদানি হয় মালয়েশিয়া থেকে।
জনপ্রিয় হচ্ছে সয়াবিনের বিকল্প ভোজ্যতেল
দেশের বাজারে সয়াবিন-নির্ভর ভোজ্যতেলের বাইরে আরও তেল বা তেলজাতীয় দ্রব্য রয়েছে। রাজধানীর বাজারে সরিষার তেল, রাইস ব্রান অয়েল, পামওয়েল, ঘি, ডালডা, নারিকেল তেল, অলিভ অয়েল, কালোজিরার তেল বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল হিসেবে। এ তেলগুলো দিনদিন ভোক্তাদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে।
সরিষার তেল: সরিষার তেল বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গেই মিশে আছে। কয়েক দশক আগেও দেশের বাজারে সরিষার তেল ছিল শীর্ষে। তবে সয়াবিন আমদানির পর থেকে সরিষার তেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে সয়াবিন তেল। মূলত করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারনীতি এবং সরিষার তেলের তুলনায় দাম কম হওয়ার কারণে দেশের বেশিরভাগ ক্রেতা এখন সয়াবিন তেলের ভোক্তা হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে দাম বেশি হওয়ায় সরিষার তেল পরিণত হয়েছে শৌখিন পণ্যে। তবে গত ২-৩ বছর ধরে সরিষার তেলের ব্যবহার বাড়ছে। সরিষা বীজ থেকে তৈরি হয় সরিষার তেল। রাজধানীতে প্রতি লিটার সরিষা তেল বিক্রি হয় ২৩০ থেকে ৩০০ টাকা।

রাইস ব্রান অয়েল। ছবি: ফ্রীপিক
রাইস ব্রান অয়েল: রাইস ব্রান অয়েল তৈরি হয় ধানের তুষ থেকে, যা একসময় ব্যবহৃত হতো জ্বালানি আর গোখাদ্য হিসেবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কল্যাণে এখন তা নিংড়ে তেল বের করা হচ্ছে। বাজারে বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের রাইস ব্রান অয়েল রয়েছে। আবার আমদানিও করা হয়। দাম প্রতি লিটারে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা।
পামঅয়েল: পাম তেল একটি উদ্ভিজ তেল। এটি পাম ফলের নির্যাস থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আহরণ করা হয়। পাম তেল লালচে রংয়ের হয়। আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ব্রাজিল অঞ্চলে পাম তেল রান্নায় ব্যবহৃত হয়। দেশে পাম তেল উৎপন্ন হয় না বললেই চলে। আমদানি নির্ভর এই তেল বাজারে পাওয়া যায় ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকার মধ্যে।
নারিকেল তেল: নারিকেল তেলের ব্যবহারের কথা উঠলেই শুধু মনে হয় চুল ছাড়া এই তেলের ব্যবহার আর নেই। তবে খাবার উপযুক্ত নারিকেল তেল প্রতিদিন খেলে তা দেহের এনার্জি বৃদ্ধিতেও কাজ করে। রান্নায় বিশুদ্ধ নারকেল তেল ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশে নারিকেল তেল কেবল চুলে ও শরীরে ব্যবহার হলেও শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশে তা রান্নাতেও ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে নারকেল তেলের মাসিক চাহিদা প্রায় ১ হাজার ২০০ টন। দেশে নারিকেল তেলের দাম বিভিন্ন ব্র্যান্ড ভেদে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা প্রতি লিটার।

অলিভ অয়েল। ছবি: ফ্রীপিক
অলিভ অয়েল: দামে বেশি হলেও স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বর্তমানে অনেকেই রান্নায় অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল ব্যবহার করেন বা করতে চান। অলিভ অয়েল শরীরে ব্যবহারের পাশাপাশি রান্নার জন্যও উপযুক্ত। এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল সালাদ ড্রেসিং হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সবজি রান্না করার জন্যও এই অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশের বাজারে প্রতি লিটার জলপাই তেল কিনতে খরচ করতে হবে ১০০০ থেকে ১৩০০ টাকা।
সূর্যমুখী তেল: আমাদের দেশের পরিচিত একটি তেল হচ্ছে সূর্যমুখী তেল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফুলের বাণিজ্যিক চাষ হয়ে থাকে। দেশে সূর্যমুখী তেলের চাহিদা পূরণ করা হয় আমদানি করে। পাঁচ লিটারের এক বোতল সূর্যমুখী তেলের দাম ১২৫০ টাকা থেকে ১৪০০ টাকা।

সূর্যমুখী তেল। ছবি: ফ্রীপিক
ঘি: গরু বা মহিষের দুধ থেকে ঘি তৈরি হয়। ভাত, ডাল বা খিচুড়িতে এক চামচ ঘি দিলেই এর স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ। আবার মুরগির মাংস বা খাসির মাংসের ঘি রোস্টও খেতে সুস্বাদু। বর্তমানে বাজারে এক কেজি খাঁটি ঘি কিনতে খরচ হবে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আবার বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কৃত্রিম ঘি পাওয়া যায় ৭০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।
ডালডা: ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ তেল (পাম, সয়াবিন) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আংশিক হাইড্রোজেনেশন করা হলে তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো অর্ধকঠিন ডালডা বা বনস্পতি ঘি উৎপন্ন হয়। বাসাবাড়িতে এর ব্যবহার কম হলেও বেকারিপণ্য ও বাণিজ্যিক উৎপাদনে এটি বহুল ব্যবহৃত হয়। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির ডালডা পাওয়া যায় ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে।
ভোজ্যতেলের ৪০% চাহিদা মেটাবে সরিষা
দেশে সরিষার উৎপাদন দুই বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছে সরিষা তেল উৎপাদনও। ফলে দাম কমে আসায় ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সরিষার তেল উৎপাদন ও বিপণনে যুক্ত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানও। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর আগে দেশে সরিষা তেলের দাম সয়াবিনের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। তবে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় সয়াবিনের দাম দেশের বাজারে বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরিষা উৎপাদন বাড়াতে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্পের সুবাদে কমতে থাকে সরিষা তেলের দাম। বর্তমানে খোলা সরিষা তেল ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম কাছাকাছি। ফলে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার আগের চেয়ে বেড়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউএসডিএর ‘অয়েল সিডস অ্যান্ড প্রডাক্টস অ্যানুয়াল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ বিপণন বর্ষে (অক্টোবর-সেপ্টেম্বর) দেশে সরিষা তেলের সরবরাহ ছিল ৫ লাখ ৬০ হাজার টন। এর মধ্যে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার হয় ৪ লাখ ৯৫ হাজার টন। এরপর ২০২২-২৩ বিপণন বর্ষে মোট সরিষা তেল সরবরাহ হয় ৫ লাখ ৫১ হাজার টন। এর মধ্যে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার হয় পাঁচ লাখ টন। ২০২৩-২৪ বিপণন বর্ষে সরিষার তেলের সরবরাহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৫ হাজার টনে। এর মধ্যে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার হয় ৬ লাখ ৩০ হাজার টন। ইউএসডিএর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ বিপণন বর্ষে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার বেড়ে হবে ৬ লাখ ৬০ হাজার টন।

সরিষার তেল। ছবি: ফ্রীপিক
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে দেশে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ ৪৪ হাজার টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়া হয়। এরমধ্যে ১০ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টন সরিষা উৎপাদন হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৬৩ হাজার টন। যদিও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে সরিষা উৎপাদন ছিল ৬ লাখ ৫ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ লাখ ৮৩ হাজার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ৮৭ হাজার ও ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৫৪ হাজার টন।
সরিষা উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাঁচ বছর মেয়াদি ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ২২২ কোটি টাকার এ প্রকল্প ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। দেশের ২৫০টি উপেজলায় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্প চলবে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে ২৬ লাখ টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পের অধীনে চলতি অর্থবছর থেকে ভোজ্যতেলে আমদানি-নির্ভরতা কমাতে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে নয় লাখ টন সরিষার তেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ভোজ্যতেলের ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটাবে।
‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক জসীম উদ্দিন হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, আমরা দানাজাতীয় শস্য ও ফলমূলে এগিয়ে গেলেও ভোজ্যতেলে অনেক পিছিয়ে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরিষা চাষে উৎসাহিত করতে কৃষককে প্রণোদনার মাধ্যমে সার ও বীজ সহায়তা দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই এখন সরিষা চাষে ঝুঁকছেন। সরিষা একটি বাড়তি ফসল। অন্য ফসল কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ পূরণ করা।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ বিপণন বর্ষে সরিষা তেল উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার টন। যদিও সংস্থাটি এর আগে ৫ লাখ ১৮ হাজার টনের আভাস দিয়েছিল।
মূলত অভ্যন্তরীণভাবে সরিষা উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় তেল উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া উৎপাদন ও ভোগ বেড়ে যাওয়ায় দেশে বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন সরিষা তেল উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে সিটি গ্রুপ, মেঘনা, স্কয়ার, আকিজ, এসিআই, পারটেক্স গ্রুপ, প্রাণ ফুডস ও ওরিয়ন অন্যতম।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাদ ও ঘ্রাণের কারণে দেশের মানুষ সয়াবিন ও পাম অয়েলের চেয়ে সরিষা তেল রান্নায় ব্যবহার করতে পছন্দ করে। আবার সয়াবিন ও পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধি ও সরিষা তেলের দাম কমে আসায় অনেকেই এখন রান্নার কাজে সরিষা তেল ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির প্রধান হেলাল উদ্দিন হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, তেলের দাম বাড়ার কারণে সরিষার তেলের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই চাহিদা তেলের মোট চাহিদার ৫-৭ শতাংশ পূরণ করে বলে জানান তিনি। আর বাকি পুরোটাই আমদানি করে আনতে হয় তবে রোজার সময়ে সরিষার তেলের চাহিদা বেড়ে যায় বলেও জানান তিনি। তখন ভোজ্যতেলের চাহিদা ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে।