Home টপ পোস্ট আলোচিত ‘বিটকয়েন’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কেন?

আলোচিত ‘বিটকয়েন’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কেন?

ইকবাল হোসেন
৫২৪ views
বিটকয়েন

বর্তমান বিশ্বে সবসময় আলোচনায় থাকা শব্দগুলোর অন্যতম ‘বিটকয়েন’। ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েনকে অনেকেই ভবিষ্যতের মুদ্রা বলে মনে করেন। ক্রিপ্টোকারেন্সির বেচাকেনা বিশ্বব্যাপী এক ধরনের ব্যবসা হিসেবে উপনীত হয়েছে। এ মুদ্রা কিনে লাভজনক দামে অন্যের কাছে বিক্রি করার আগ্রহ থেকেও অনেকে এই ‘অস্থির’ মুদ্রা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপারে শুরু থেকেই রক্ষণশীল অবস্থানে রয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন নিষিদ্ধ বাংলাদেশে।

গত শুক্রবার (২২ নভেম্বর) একটি বিটকয়েনের দাম ৯৯ হাজার ৩৮০ ডলারে ছাড়িয়েছে। এই দাম বিটকয়েনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি মুদ্রায় একটি বিটকয়েনের মূল্য ১ কোটি ১৯ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিটকয়েনের দাম হু হু করে বাড়ছে। আর্থিক বাজারের প্রত্যাশা— ট্রাম্প প্রশাসন ক্রিপ্টো-বান্ধব হবে।

বিটকয়েন কী?
বিটকয়েন এক ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রা। ইন্টারনেটের মাধ্যমেই এই মুদ্রার লেনদেন হয়ে থাকে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে জাপানের একজন নাগরিক সাতোশি নাকামোতো নামের কেউ বা একদল সফটওয়্যার বিজ্ঞানী এই ‘ক্রিপ্টোকারেন্সির’ উদ্ভাবন করেন। যদিও এই ব্যক্তির আসল নাম বা পরিচয় এখনও জানা যায়নি। ২০১৩ সালের দিকে এই মুদ্রার দাম ১০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে।

ইন্টারনেট ব্যবহার করে দুজন ব্যবহারকারীর মধ্যে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করেও এটা সরাসরি আদান-প্রদান (পিয়ার-টু-পিয়ার) করা হয়। এই লেনদেনের তথ্য ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু এই মুদ্রার লেনদেন তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো কোনো কর্তৃপক্ষ থাকে না।

 

bcoin

ছবি: ফ্রীপিক

 

বিটকয়েন তৈরি বা কেনার পর তা গ্রাহকের হিসাবে জমা থাকে। পরবর্তীতে তিনি সেগুলো ব্যবহার করে পণ্য কিনতে পারবেন বা বিক্রিও করে দিতে পারবেন। বিক্রি করলে বিটকয়েনের পরিবর্তে প্রচলিত অর্থে তা গ্রহণ করা যায়। বিভিন্ন কম্পিউটার ব্যবহার করে লেনদেন করা হলেও সেসব তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে হালনাগাদ করা হয়ে থাকে।

যেহেতু বিটকয়েনে লেনদেনে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে না এবং এর লেনদেনের গতিবিধি অনুসরণ করা যায় না, ফলে এটা মাদক, কালোবাজারি ও অর্থ পাচারে ব্যবহার হচ্ছে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।

গত কয়েক বছরে বিটকয়েনের ইকোসিস্টেম বা বাজার ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়েছে, অনলাইনে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জও চালু হয়েছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রচলনের প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বের কোনো আইনগত কর্তৃপক্ষ এই মুদ্রাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বর্তমানে কয়েকটি দেশের (যেমন- জাপান, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কেন্দ্রীয় ব্যাংক/মুদ্রা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনকে বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশ, মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো প্রভৃতি দেশে বিটকয়েন এখনও নিষিদ্ধ।

নিষিদ্ধের নানা কারণ
২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম বিটকয়েনে লেনদেনের ব্যাপারে সতর্কতা জানিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে না বিধায় এর বিপরীতে আর্থিক দাবির কোনো স্বীকৃতিও নেই।

ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের দ্বারা মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে দিয়েছে। এ ধরনের লেনদেনের মাধ্যমে আর্থিক এবং আইনগত ঝুঁকি রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করেছে।

এছাড়া অনলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লেনদেনকারী গ্রাহকরা ভার্চুয়াল মুদ্রার সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকিসহ বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন বলে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা হ্যালো বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশে বিটকয়েনের কোনো অনুমোদন নেই। যেহেতু অনুমোদন নেই, সুতরাং এই জাতীয় লেনদেন বৈধ নয়। যদি আমাদের নজরে এই জাতীয় লেনদেনের খবর আসে, তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

ভবিষ্যতে বিটকয়েনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা নেই।

বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, তাই বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

 

বিটকয়েন

ছবি: সিএনবিসি

 

বাংলাদেশে বিটকয়েনের ব্যবহার
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ভার্চুয়াল মুদ্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাংলাদেশি গ্রাহকেরা বিভিন্ন বিদেশি ভার্চুয়াল অ্যাসেট সার্ভিস প্রোভাইডার ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়, পুনর্বিক্রয়, হস্তান্তর ও বিনিময় ইত্যাদি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। গ্রাহক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এ ধরনের কোনো লেনদেন যেন সম্পন্ন না হয় তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশে ঠিক কতজন বিটকয়েন কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশে যারা আউটসোসিং করছেন তাদের কেউ কেউ বিটকয়েন কেনাবেচা করে থাকেন। কিন্তু অবৈধ হওয়ায় সেটা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। সাধারণত বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে এই লেনদেন হয়ে থাকে। অর্থ আদান-প্রদানে বিদেশে থাকা বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনদের সহায়তা নেওয়া হয়।

কয়েক বছর আগেও উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটার ব্যবহার করে বিদেশি সহযোগীদের সাথে মিলে বিটকয়েন মাইনিংয়ের কাজও করা হতো। কিন্তু তাতে বিদ্যুৎ বিল বেশি আসায় এই প্রবণতা কমে গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ‘হ্যালো বাংলাদেশ’কে বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশ এখনও এটার জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ আমাদের মূল ধারার মুদ্রা ব্যবস্থাপনার বাইরে এটা হচ্ছে। শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও এটার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যে নীতি দরকার, সেটার অভাব রয়েছে। এটার ভেতর এখনও অনেক ধরণের ফটকাবাজি চলছে। এটা নিয়ে আসলে কোনো ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক, আইনি প্রস্তুতি নেই। তথ্যের অস্বচ্ছতাও আছে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু পৃথিবীতে এই মুদ্রা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, ফলে পুরোপুরি এটাকে অস্বীকার করারও উপায় নেই। পুরোপুরি বন্ধ না করে রেখে এটার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা করা উচিত। কারণ বিশ্বে যদি একসময় এটা প্রচলিত হয়ে ওঠে, তাহলে সেটার সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সুতরাং সে জন্য প্রস্তুতি নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একেবারে মুখ ফিরিয়ে না রেখে তাদের এটা নিয়ে গবেষণা করা, যৌক্তিকতা, অযৌক্তিকতা যাচাই করা উচিত। বিটকয়েন কোথায় যাচ্ছে, সেটার দিকে নজর রাখা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে যদি বিটকয়েনের ওপর বড় লেনদেন করতে হয়, তখন বিপদে পড়তে হবে না।

চীন এবং ভারতসহ কয়েকটি দেশ নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরির পরিকল্পনা করছে। তবে বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির অনুমতি দেওয়ার আগে এটা নিয়ে আরও ভালো করে গবেষণা করে, পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ