বৃদ্ধ বয়সে সাধারণত মানুষ বিশ্রামকেই জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে, কিন্তু দাবার জগতে বাংলাদেশি কিংবদন্তি রানী হামিদ এই ধারণাকে ভেঙে দিয়েছেন। বর্ষীয়ান এই দাবাড়ু ৩০ পেরোনোর পর যখন তার ক্যারিয়ার শুরু করেন, তখন কেউ ভাবেনি যে তিনি দাবার জগতে নতুন আলো ছড়াবেন। এখন ৮০ বছর বয়সেও, তিনি নিজের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে চলেছেন। ২০২৪ সালের দাবা অলিম্পিয়াডে তার অসাধারণ পারফরম্যান্স প্রমাণ করে, বয়স শুধুই একটি সংখ্যা; প্রতিভা ও সাহসের কাছে তা কোনদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
দাবা অলিম্পিয়াড ২০২৪
২০২৪ সালের ১০ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াডের আসর বসে। টুর্নামেন্টের তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচে বার্বাডোসের লিশে স্প্রিংগারকে পরাজিত করেন রানী। এছাড়াও টুর্নামেন্টে পরপর ছয়টি ম্যাচে একটানা জয় পান তিনি। এই আসরে দ্বীপরাষ্ট্র গার্নসির ৮৩ বছর বয়সী পোলিন উডওয়ার্ডের পরে দ্বিতীয় বর্ষীয়ান দাবাড়ু ছিলেন রানী।
রানী হামিদের পথচলা
সাধারণত ফিজিক্যাল গেমগুলোতে ৩০-৩৫ বছরেই অবসরে চলে যান অ্যাথলেটরা। কিন্তু মাইন্ড গেমের মাস্টার রানী হামিদ দাবা খেলা শুরু করেছেন ৩৩ বছর বয়সে! ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কোয়ার্টারে থাকার সময় হামিদদের প্রতিবেশী ছিলেন জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ড. আকমল হোসেন। তার সহযোগিতায় ১৯৭৬ সালে মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় নাম লেখান রানী। এটিই ছিল তার জীবনে প্রথমবারের মতো বড় কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ।

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশে নারীদের উপস্থিতি কম। সেখানে নারীদের ভূমিকার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দাবাড়ু রাণী হামিদ। সর্বাধিক ২০টি অলিম্পিয়াডে খেলা একমাত্র দাবাড়ু তিনি, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছর জাতীয় শিরোপা জিতেছেন। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৩ সালে যখন তিনি ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিলেন, তখন তিনি হেলেন মিলিগানের সাথে যুগ্ম বিজয়ী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে শুরু করে তিনি সব বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে খেলেছেন। ১৯৮৫ সালে ফিদে নারী আন্তর্জাতিক মাস্টার (ডব্লিউআইএম) উপাধিতে ভূষিত হন। ২০১৭ সালে তিনি দিল্লিতে কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতেছেন। পরের বছর রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত দাবা বিশ্বকাপ ২০১৮-তে ‘জার্নালিস্টস চয়েস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন।
মজার ঘটনা
১৯৮১ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদের এক টুর্নামেন্টে ‘খাদিলকার সিস্টার্স’ নামে খ্যাত তিন দাবাড়ু বোনের সর্বকনিষ্ঠ জন, রোহিনী খাদিলকারের অনেক আধিপত্য ছিল। তিনি সেই টুর্নামেন্টে ছিলেন রানী হামিদের প্রতিদ্বন্দ্বী। তার কোচ রানী হামিদের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে লেটেস্ট কোন ইনফরমেটরি থেকে তিনি দাবার এই কৌশল গুলো শিখেছেন। অথচ রানী তখন জানতেনও না যে দাবা খেলার কৌশল নিয়ে লিখা কোনো বই আছে!
১৯৮৪ সালে রানী হামিদ পুরুষ দলের গ্রিসে দাবার টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু টেন্ট থেকে চা খেতে বের হওয়ার পর বাধে বিপত্তি। ঢুকার মুখে গার্ড তাকে টেন্টে প্রবেশ করতে দেয়নি কারণ পুরুষ টিমের সাথে উনি খেলবেন এটাই গার্ডকে বুঝানো যাচ্ছিলো না ভাষাগত সমস্যার কারণে। গার্ড তাকে ইশারায় বার বার মেয়েদের টিমের টেন্টে যেতে বলছিলেন। পরবর্তীতে সে যাত্রায় কোনোরকমে পার পেয়ে যান এবং টুর্নামেন্টে শেষ করেন রানী।
আনন্দের জন্যেই দাবা খেলেন রানী। বর্ষীয়ান দাবাড়ু রানী হামিদের ক্যারিয়ার। বিশ্রামের চিন্তা না করে ৮০ বছর বয়সেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে তিনি বিশ্ব দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছেন।