এক দশক পর ৫ জানুয়ারি রোববার বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি হারল ভারত। পাঁচ টেস্ট সিরিজে ১-৩ ব্যবধানে হেরেছে রোহিত শর্মারা। রোববার পঞ্চম টেস্টে ভারত ৬ উইকেটে হারে। প্রথম টেস্টে পার্থে জিতলেও এর পর অ্যাডিলেডে হেরে যায়। ব্রিসবেনে বৃষ্টির কারণে হার বাঁচায় ভারত। মেলবোর্ন ও সিডনিতে আবার হারে ভারত।
এসব হারের নেপথ্যে রয়েছে বেশ কিছু কারণ। পর পর তিনবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জেতার সুযোগ ছিল ভারতের। কিন্তু সেটা এবার হল না। শুরুটা ভাল হলেও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি ভারত। হল না বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠাও। এর আগে দুইবার ফাইনাল খেলে হারতে হয়েছিল ভারতকে। কিন্তু এবার যোগ্যতা অর্জনই করতে পারল না তারা।
ব্যাটিং ব্যর্থতা
ভারতের হারের সবচেয়ে বড় কারণ ব্যাটিং ব্যর্থতা। সিরিজজুড়ে ব্যাটাররা ব্যর্থ হয়েছেন। যে টেস্ট ভারত জিতেছিল, তাতেও প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানে শেষ হয় ভারত। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে মাত্র একবার ৩০০ রানের গণ্ডি পার করেছিলেন বিরাট কোহলিরা। অস্ট্রেলিয়া সেখানে তিনবার ৩০০ রানের গণ্ডি অতিক্রম করেছে।
যশস্বী জয়সওয়াল (৩৯১ রান) ও নীতীশ কুমার রেড্ডি (২৯৮ রান) দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন। সেখানে বিরাট (১৯০ রান) এবং রোহিত শর্মার (৩১ রান) মতো সিনিয়ররা ব্যর্থ। সেই সঙ্গে ঋষভ পন্থের দায়িত্বজ্ঞানহীন শট। পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই শট খেলতে গেলেন তিনি। তাতে উইকেট দিয়ে এলেন। দলকেও ডোবালেন। মেলবোর্নে পন্থ যদি আরও কিছু ক্ষণ ধৈর্য ধরে ব্যাট করতেন, তা হলে ম্যাচ বাঁচাতেও পারত ভারত।
মেলবোর্ন ও অ্যাডিলেডে ভারত লড়াই করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেও ব্যাটিং ব্যর্থতায় হেরে যায়। হাতে রান থাকলে ম্যাচ অন্য রকম হলেও হতে পারত। ভারতের হারের জন্য ব্যাটারদের দায়ী করেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “ভারত ভাল ব্যাটিং করতে পারেনি। টেস্টে আরও ভাল ব্যাটিং করতে হবে। না হলে জেতা মুশকিল। ১৭০-১৮০ রান করে ম্যাচ জেতা যায় না। ৩৫০-৪০০ রান করতে হবে।”
রোহিতের দলে ফেরা
প্রথম টেস্টে রোহিত খেলেননি। ভারতীয় দল সেই টেস্ট ২৯৫ রানে জিতেছিল। পার্থে ভারত তিনজন পেসার ও দুইজন অলরাউন্ডার নিয়ে খেলেছিল। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের কারণে প্রথম টেস্টে খেলেননি রোহিত। তিনি দ্বিতীয় টেস্টে দলে যোগ দেন। তাতেই ভারতীয় দলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। রোহিত অ্যাডিলেড ও ব্রিসবেনে মিডল অর্ডারে খেলেন। কারণ প্রথম টেস্টে দুই ওপেনার যশস্বী জয়সওয়াল এবং লোকেশ রাহুল ভাল খেলেছিলেন। সেই জুটি ভাঙতে চাননি রোহিত।
ভারতীয় ক্রিকেটার রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি
তবে তিনি মিডল অর্ডারে রান করতে পারেননি। তাতে দুর্বল হয়ে যায় মিডল অর্ডার। মেলবোর্নে হঠাৎ তিনি ওপেন করতে নেমে পড়লেন। তাতে রাহুলকে তিন নম্বরে পাঠানো হল। বাদ পড়তে হল শুভমন গিলকে। একজন ক্রিকেটারকে জায়গা করে দিতে দুইজনকে নিজেদের জায়গা ত্যাগ করতে হল। সিডনিতে যদিও রোহিত নিজেকেই দল থেকে সরিয়ে নিলেন।
শামির না থাকা
গত বছর এক দিনের বিশ্বকাপের পর থেকে ভারতীয় দলে পাওয়া যাচ্ছে না মোহাম্মদ শামিকে। চোটের কারণে এখনও টেস্ট খেলার মতো ফিট নন তিনি। বার বার তার দলে ফেরার গুঞ্জন তৈরি হলেও তা সম্ভব হয়নি। তাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর ঝুঁকি নেননি ভারতীয় দলের নির্বাচকরা। শামি না থাকায় সঙ্গীহীন হয়ে পড়েন জসপ্রীত বুমরাহ। তিনি পাঁচ ম্যাচের সিরিজে শেষ দিনে বল না করেও ৩২টি উইকেট তুলে নেন। তিনটি ইনিংসে ৫ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন। গড় ১৩.০৬। সিরিজ়ের সেরা ক্রিকেটারও হয়েছেন তিনি।
তবে ভারতীয় বোলারদের থেকে সেভাবে সাহায্য পাননি। মোহম্মদ সিরাজ নিজের ২০ উইকেট। তার গড় ৩১.১৫। কোনও ইনিংসেই ৫ উইকেট নিতে পারেননি তিনি। তৃতীয় পেসার হিসাবে কখনও হর্ষিত রানা, কখনও আকাশ দীপ আবার শেষ ম্যাচে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণকে খেলানো হয়েছে। হর্ষিত ও আকাশ দু’টি করে ম্যাচ খেলেছেন। হর্ষিত নিয়েছেন ৪ উইকেট এবং আকাশ নিয়েছেন ৫ উইকেট। অলরাউন্ডার নীতীশ মাত্র ৫ উইকেট নিয়েছেন। তিনি বল হাতে খুব বেশি ভরসা দিতে পারেননি দলকে। ফলে শামির অভাব প্রতি ম্যাচেই বোধ করেছে ভারতীয় দল।
রোহিতের নেতৃত্ব
তার নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। তবে টেস্টে অধিনায়ক হিসাবে সেভাবে নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারলেন না রোহিত। অস্ট্রেলিয়াকে একাধিকবার বাগে পেয়েও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয় ভারত। যার জন্য অবশ্যই দায়ী রোহিতের রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব। ব্রিসবেন ও মেলবোর্নে ভারতের কাছে সুযোগ ছিল আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার। কিন্তু রোহিত অপেক্ষা করলেন। তাতে অস্ট্রেলিয়া সুযোগ পেয়ে গেল ম্যাচে ফেরার।
ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াও বোলার পরিবর্তনেও রোহিত বার বার ভুল করেছেন। দলে ওয়াশিংটন সুন্দরকে নিলেও তাকে মেলবোর্নে সেভাবে ব্যবহারই করেননি। যা ভারতকে বিপদে ফেলে দেয়। ব্যাটার হিসাবেও ব্যর্থ রোহিত। সিরিজে তিনটি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। করেছেন মাত্র ৩১ রান।
ব্যর্থ কোহলি
পার্থে শতরান করেন কোহলি। সবার ধারণা ছিল হয়তো ফর্মে ফিরলেন। কিন্তু ওই শতরানটি বাদ দিলে কোহলি বলার মতো তেমন ইনিংস খেলেননি। পাঁচ ম্যাচে তাঁর মোট সংগ্রহ ১৯০ রান। প্রথম টেস্টের শতরান বাদ দিলে বাকি চারটি টেস্ট মিলিয়ে ৯০ রান করেছেন কোহলি। ১০ রানের কমে আউট হয়েছেন পাঁচ বার। ৩০ রানের গণ্ডি পার করেছেন এক বার।
অস্ট্রেলিয়ার সব বোলারেরাই বুঝে যায় কোহলিকে অফ স্টাম্পের বাইরে বল করতে হবে। তা হলেই তিনি জব্দ। চতুর্থ বা পঞ্চম স্টাম্পে বল থাকলে যে কোনও ব্যাটারের খেলতে অসুবিধা হয়। বুঝতে অসুবিধা হয়, সেই বল তারা ছাড়বেন না খেলবেন। বিরাট বারবার সেই রোগে ভুগলেন ও উইকেট দিয়ে এলেন। বিরাট রান না পাওয়ায় ভারতের মিডল অর্ডার নড়বড়ে হয়ে যায়। গোটা দলের ওপর সেটার প্রভাব পড়ে।
