মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করে মার্কিন মসনদে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন করেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৭ নভেম্বর সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, নির্বাচনে ট্রাম্প নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছেন।
দুইবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন অথচ পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন না— এমন মাত্র দুজন প্রেসিডেন্টের একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার আগে ১৮০০ সালে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ট্রাম্পের মতো একবার বিরতির পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
ঐতিহাসিক এই বিজয়ের পর ট্রাম্প ভবিষ্যতে তৃতীয় মেয়াদেও ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি কি সত্যিই তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনে লড়বেন? আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী এটা কি সম্ভব? এমন নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতিসহ সব অঙ্গনে। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করতে পারবেন কিনা, কি বলে মার্কিন আইন?
আউটব্রেন আইন:
আমেরিকার সংবিধানের একটি সংশোধনী হচ্ছে আউটব্রেন আইন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের বলে কেউ দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারেন না। তাহলে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৮ সালে তৃতীয় মেয়াদে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা সম্ভব? এটি জানতে হলে আইনের আলোকে জানতে হবে।
তৃতীয় মেয়াদে কি কেউ দায়িত্ব পালন করেছেন?
১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চারবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল সংবিধানে একজন প্রেসিডেন্ট কত মেয়াদ পর্যন্ত থাকতে পারবেন, তখন এমন কিছুই উল্লেখ ছিল না।
কিন্তু পরবর্তীতে সংবিধানের ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে এর সীমারেখা টানা হয়। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে চার বছর মেয়াদে দুইবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টি সীমাবদ্ধ করা হয়। ধারাবাহিকভাবে প্রেসিডেন্ট থাকুন বা না থাকুন, তাতে কিছু যায় আসে না। দুইবারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে পারবে না বলে সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
রুজভেল্টের মৃত্যুর দুই বছর পর মার্কিন কংগ্রেসে ২২তম সংশোধনী পাস হয়। ১৯৫২ সালের নির্বাচন থেকে এই আইনটি কার্যকর হয়। ওই বছর রিপাবলিকান প্রার্থী ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার ডেমোক্র্যাট অ্যাডলাই স্টিভেনসনকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর থেকে কেউ দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট, ছবি: এপি
কারচুপির অভিযোগ:
২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হেরেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে বছরের আগস্টে একটি সমাবেশে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প বলেছিলেন যে তিনি পরের নির্বাচনে জয়ী হবেন। তারপর ‘আরও চার বছর ক্ষমতা থাকতে পারবেন’। কারণ হিসেবে ট্রাম্প উল্রেখ করেন, ডেমোক্র্যাটরা তার প্রচারে গুপ্তচরবৃত্তি চালায়। তাকে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করা হয় বলে তিনি দাবি করেন। তবে দাবি পক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি।
চলতি বছরের জুলাই মাসে রক্ষণশীলদের এক অনুষ্ঠানে ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাকে ভোট দিয়ে জয়ী করতে বলেন। এরপর খ্রিস্টানদের ‘আর ভোট দিতে হবে না’ বলেও জানান তিনি। ট্রাম্পের এমন বক্তব্যকে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করার ইঙ্গিত মনে করেন অনেকে।
যেভাবে আলোচনায় আসে তৃতীয় মেয়াদ:
ফোর্বসের মতে, ট্রাম্প আরেকটি সমাবেশে বলেছিলেন যে তিনি যদি ২০২০ সালের নির্বাচনে জিতেন তাহলে তৃতীয় মেয়াদে লড়ার জন্য ‘আলোচনা’ করবেন। এরপর থেকেই ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করার বিষয়টি আলোচনার সূতপাত হয়।
সিবিএস নিউজ অনুসারে, ট্রাম্প বারবার ভোটারদের কাছে ‘শুধু এবার’ ভোট দিতে বলেন। তবে গত বছর এনবিসি নিউজের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি পরের বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করতে চান কি না, উত্তরে ট্রাম্প সরাসরি ‘না’ বলেছিলেন।
২০২৪ সালের এপ্রিলে টাইম ম্যাগাজিনকে ট্রাম্প বলেছিলেন যে তিনি বর্ধিত মেয়াদের ‘পক্ষে থাকবেন না’। তবে নির্বাচনের প্রাক্কালে তার দুটি অস্পষ্ট মন্তব্য গুজব ছড়ায় যে ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদেও লড়াই করবেন।
বিশ্লেষক অভিমত:
ট্রাম্পের অস্পষ্ট মন্তব্য প্রসঙ্গে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জন ফোর্টিয়ার বলেন, খ্রিস্টান ইভেন্টে অংশ নিয়ে ট্রাম্প যে মন্তব্যগুলো করেছেন তা বাস্তবতার প্রেক্ষাপটের বাইরে নিতে হবে। নির্বাচনে খ্রিস্টান ভোটারদের পক্ষে নিতেই এমন মন্তব্য করেছেন। এটিকে ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন না এই সিনিয়র রিসার্চ।
ট্রাম্প কেন অতিরিক্ত মেয়াদে থাকবেন না তার কারণ তুলে ধরে ফোর্টিয়ার উল্লেখ করেন, ট্রাম্প ইতিপূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি এই নির্বাচনে (২০২৪) হেরে গেলে ২০২৮ সালে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন না। এক ধরনের বিষণ্ণতা প্রকাশ করেই তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন।
বয়স-সম্পর্কিত বিষয়ে সচেতন মার্কিনীরা:
ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনে লড়বেন কিনা— এই প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়ে জন ফোর্টিয়ার বলেন, ট্রাম্পের বয়স তাকে তৃতীয় মেয়াদে যেতে দেবে না। ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে তার বয়স হবে ৮২ বছর।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দ্বিতীয় মেয়াদে না লড়ার ঘোষণাই প্রমাণ করে যে আমেরিকান জনগণ বয়স-সম্পর্কিত বিষয়ে সচেতন। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আশি-ঊর্ধ্ব প্রার্থীদের মার্কিন ভোটাররা ভালোভাবে দেখে না। জো বাইডেনই তার চাক্ষুষ প্রমাণ বলে মনে করেন জন ফোর্টিয়ার।
কমনওয়েলথ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক জোসেফ কসগ্রোভের মতে, তৃতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের নির্বাচন করা ‘কার্যত অসম্ভব’। কারণ এই জন্য তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, যা তার জন্য একটি ‘কঠিন কাজ’।
সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব:
সংবিধানের একটি সংশোধনী প্রস্তাব করার জন্য হাউস ও সিনেট—উভয়ের দুই-তৃতীয়াংশের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এছাড়া রাজ্য সরকারের তিন-চতুর্থাংশ অনুমোদনের প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতেও এটি সহজ না৷ এমনকি রিপাবলিকানরা হাউস ও সিনেট উভয় কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এতটাই কম হবে যে ২২তম সংশোধনীতে হাত দেওয়ার ঘটনা ঘটবে না। কারণ নিজের দলের লোকেরাই অনেকে ট্রাম্পকে পছন্দ করেন না। তাই তৃতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সম্ভবনা উড়িয়ে দিয়েছেন দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দ্য স্কাই নিউজ থেকে অনূদিত