বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার প্রথমেই উঠে আসে। ১৯৭১-এর স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি নানা সংকটে নিমজ্জিত, যেখানে গণতন্ত্রের নামে চলছে ভণ্ডামি ও গুণ্ডামির প্রকাশ। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা এবং ক্ষমতার লোভের কুপ্রভাব এই সংকটের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের চক্রে আবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রকৃত গণতন্ত্র ও জনকল্যাণের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
জনকল্যাণের নাম হলেও প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে স্বার্থপরতার আধিপত্য বিরাজ করছে। ক্ষমতাসীন দলের জন্য আইনের প্রয়োগ একরকম, আর বিরোধী দলের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ১৬ বছরে প্রশাসন থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ পর্যন্ত ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দমন করার প্রয়াস দেখা গেছে, যার ফলে গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো ও নীতিনৈতিকতা ভেঙে পড়েছে।
দুর্নীতির চর্চা যেন এক অদ্ভুতভাবে স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট, বিদেশে পাচার, সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম এবং স্বজনপ্রীতি— এসব রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ। গণতান্ত্রিকভাবে সরকারের বৈধতা প্রমাণ করার জন্য ভোট প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হলেও বহুবার ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে, ফলে জনগণের আস্থা বিনষ্ট হয়েছে। যোগ্যতার চেয়ে ক্ষমতার দাপট ও চাটুকারিতা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, যার ফলস্বরূপ সমাজে বিচারহীনতা এবং শোষণের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একসময় স্বৈরাচারের অবসান ঘটালেও, দুর্নীতির এই চক্র থেকে বের হতে না পারলে জনগণ প্রকৃত সেবা পাবে না।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়তে যা প্রয়োজন
১. সততা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা: রাজনীতিতে গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের মতামত ও চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের প্রয়োজন।
২. দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা: রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতি নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা ও কার্যক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনে অর্থনৈতিক অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
৩. নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা: অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামত মূল্যায়ন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ নির্বাচন প্রভাবিত করতে না পারে।
৪. মানবাধিকারের সুরক্ষা: জনগণের অধিকার সুরক্ষিত করতে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও শক্তিশালী মানবাধিকার সংস্থার কার্যক্রম বাড়াতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করতে হবে।
৫. তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের বিকাশ: নতুন প্রজন্মের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তাদের সততা, দক্ষতা ও জনকল্যাণমুখী মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের বর্তমান অবস্থান ও সিদ্ধান্তের উপর। সময় নষ্ট না করে, সংযম এবং দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে নতুন পথে এগোতে হবে। একটি স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক এবং কল্যাণমূলক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করতে হবে এখনই।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং শাসনযন্ত্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে অবিশ্বাস ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে অন্তবর্তীকালীন সরকারই স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কার্যকর পথ হতে পারে। তবে, প্রশ্ন হলো, এই সরকার কীভাবে জনগণের আস্থা অর্জন করবে এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারবে?
অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ
১. সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা: অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ হবে সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। এ লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং সকল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
২. দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা: দুর্নীতি দমনে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষিত রাখা এবং লুটপাট বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে জনগণের অর্থ জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়।
৩. আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের সুরক্ষায় নিয়োজিত করতে হবে এবং মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে নিরাপত্তা ও শান্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মাণে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা
অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকার উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। একটি সঠিক পথে পরিচালিত অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনে গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। এই সরকার যদি সঠিকভাবে কার্যকর হয়, তবে এটি একটি নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারে। জনগণের প্রত্যাশা, এই সরকার দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করবে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বর্তমানের সিদ্ধান্তের উপর। একটি কার্যকর, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। আমাদের সমাজের প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সচেতনতা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে এগিয়ে আসার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা সততা, দক্ষতা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাজ করতে পারে।
এটি সময়ের দাবি যে, জনগণের কল্যাণে একটি শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ সরকার গঠনের মাধ্যমে আমরা একটি কল্যাণমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন