ধ্বংস আর মৃত্যুর নগরীতে পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। জীবন বাঁচাতে ছুটে বেড়াচ্ছে অসহায় মানুষ। নেই খাদ্য, জ্বালানি আর নিরাপত্তা। স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি গাজাবাসী। এরপরও নিশ্চুপ মুসলিম প্রধান ৫৭ রাষ্ট্র। শুধু নিন্দা আর বিবৃতির মধ্যেই আটকে আছে তাদের সহমর্মিতা আর সংহতি।
চলতি সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত বা যুদ্ধ চললেও আলোচনার কেন্দ্রে গাজা। সোশ্যাল মিডিয়াসহ সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে এই যুদ্ধ। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ গাজা ধ্বংসের দৃশ্য দেখে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ ছাড়া মুসলিম প্রধান দেশগুলোর জনগণ এমন ধ্বংসলীলা দেখে ক্ষোভ আর বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে।
অবশ্য মুসলিম দেশগুলোর জনগণ চলমান ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানালেও রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের প্রতিক্রিয়া খুবই কৌশলগত। শুধু নিন্দা আর মৌখিক সমালোচনা। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই তাদের।
বরং গাজা প্রশ্নে দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য আর দ্বিধা স্পষ্ট। যদিও মুসলিম উম্মাহর অর্থ ঐক্য, সমর্থন আর একের অন্যের সঙ্গে সহযাত্রী হওয়া। কিন্তু ভ্রাতৃত্ববোধের এই বিষয়টি ৫৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে একেবারে অনুপস্থিত।

জীবন বাঁচাতে গাজার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে অসহায় মানুষ, ছবি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
গাজায় এই ঐক্য দেখা যাচ্ছে না। মৃত্যু থামাতে দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নেই। তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না মুসলিম উম্মাহর সেই দর্শন। তারা কেবল বিশ্বাস আদান-প্রদান করছে। ভুলে গেছে দায়িত্ববোধ।
মজার ব্যাপার হলো-গাজার সীমান্ত রয়েছে বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ। এগুলো হলো মিশর, জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়া। অথচ এমন বিপর্যয়ের সময়ে কোনো দেশ-ই তাদের বাঁচাতে খুলে দেয়নি সীমান্ত।
এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলো কথা বলতে পারছে না মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে। এ ছাড়া গাজাবাসীর জীবন থেকেও ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা চুক্তি ও কূটনৈতিক চাপ তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বরং কারো পক্ষে-বিপক্ষে কথা না বলে ক্ষমতাধর বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে মুসলিম দেশগুলো।

টানা বিমান হামলায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা, ছবি: আনাদুলু
পাশাপাশি যুদ্ধ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে সভা, সেমিনার, সম্মেলন আর বড় বড় প্রজেক্ট করে লাখ লাখ ডলার খরচ করা হচ্ছে। অথচ যুদ্ধ থামাতে ঐক্যবদ্ধ কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ দেশগুলো। এখানে স্পষ্ট একটা বিভাজন দেখা যাচ্ছে- ইস্তাম্বুল থেকে জার্কাতা, কায়রো থেকে করাচির জনগণ গাজায় চলমান যুদ্ধের বিভীষিকা নিয়ে আওয়াজ তুলছেন। তবুও তা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে কোনো প্রভাব ফেলছে না। এতে বুঝা যাচ্ছে জনগণের ইচ্ছা আর সরকারি নীতির মধ্যে বড় ধরনের ফারাক আছে।
যদি তাই না হবে, তবে কেন গাজায় মুসলিম দেশগুলোর নেতত্বে সম্মিলিত সামরিক জোট নেই? যে বাহিনী মানবিক সহায়তায় প্রাচীর হয়ে দাঁড়াত। কেন নেই? কূটনৈতিক বয়কট বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। শুধু জাতিসংঘে সভার পর পাশ হচ্ছে প্রস্তাব। কিন্তু বাস্তবতার কোনো প্রতিফলন নেই। কারণ দেশগুলো ভীত আর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তাই সম্মিলিত কোনো কিছু করার ইচ্ছে নেই দেশগুলোর নেতৃত্বে থাকা প্রধানদের।
অন্যদিকে গাজা প্রশ্নে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবস্থান দ্বিমুখী। এটা নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাধর দেশগুলো শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা বলে। অনেক সময় নিন্দা জানায়। তবে যখন সত্যি সত্যি এমন হয় তখন তারা চুপ! তবে তাদের থেকেও দুঃখের হলো যখন ৫৭টি মুসলিম দেশ নিশ্চুপ থাকে। এই চুপ থাকা শুধু ফিলিস্তিন নয়, এটি ইসলামের শিক্ষা, ন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধেও নির্বাক থাকা। যার অর্থ বিশ্বাসঘাতকতা।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিক্ষোভ, ছবি: ভয়েস অব আমেরিকা
ঐক্য স্থাপনের জন্য যুদ্ধ নয়, দরকার বিবেক। প্রয়োজন রাজনীতি বাদ দিয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার সাহস। মুসলমানদের বুঝতে হবে, এই নীরবতা নতুন ইতিহাস লিখবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রশ্ন করবে? যখন সাহায্যের জন্য ফিলিস্তিন কাঁদছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
এখন যদি ঐক্য না হয়, তবে কখন? এর অর্থ দেশগুলোর সচেতনার অভাব ছিল তা কিন্তু নয়। বরং রাজনৈতিক সদচ্ছিতা আর নৈতিক ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে।
২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা করে হামাস ১১৩৯ জনকে হত্যা এবং ২০০ জনকে জিম্মি করে। এরপর সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েল। যুদ্ধে এ পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের হিসাব অনুযায়ী মারা গেছে ৫০ হাজার ৮৪৬ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৫ হাজার ৭২৯ জন।
অন্যদিকে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গাজার ৭০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক ভবন, পানির পাইপলাইন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
সূত্র: মিডিল ইস্ট মনিটর, দ্য ফ্রাইডে টাইমস ও ডেইলি সাবাহ