‘এক হাজার স্থানে আমি শেষ হই, আমি পুড়ে যাই…’
ঠিক যেন নিজের কবিতার মতোই পুড়ে ছাই হলেন। যুদ্ধের এক অন্ধকার দিনে, আকাশ থেকে আগুন নেমে এলো। তেহরানের সত্তারখান এলাকার এক অ্যাপার্টমেন্টে পরিবারের সঙ্গে হারিয়ে গেলেন চিরতরে।
পার্নিয়া আব্বাসি, এক ইরানি তরুণী কবি। বয়স মাত্র ২৩। যে বয়সে স্বপ্নেরা পাখা মেলে, আঁকে জীবনের রঙ। যিনি শব্দ দিয়ে হৃদয়ের গভীরতা ছুঁয়ে যেতে জানতেন। কিন্তু সেই কণ্ঠ থেমে গেছে।
পার্নিয়া ছিলেন সৃজনশীল। তার দিনগুলো ভরে থাকত কবিতা, সুর, স্বপ্ন আর ভালোবাসায়। কোল্ডপ্লের কনসার্টে যাওয়ার ইচ্ছা, নতুন রান্না চেখে দেখার উচ্ছ্বাস, ইতালিয়ান ভাষার প্রতিটি নতুন শব্দ শেখার আনন্দ, সবই মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক পরিপূর্ণ কল্পনাময় চরিত্র। পার্নিয়া তার কবিতায় লিখেছিলেন, “এক হাজার স্থানে আমি শেষ হই, আমি পুড়ে যাই…” সেই আগুন বাস্তবেই এসে তাকে শেষ করে দিল।

পার্নিয়া আব্বাসি, যিনি শব্দ দিয়ে হৃদয়ের গভীরতা ছুঁয়ে যেতে জানতেন, ছবি : ম্যাকটুব মিডিয়া
এ যেন কেবল এক তরুণীর মৃত্যু নয়। বরং এক সম্ভাবনার, এক কাব্যিক ভবিষ্যতের, এক মানবিক স্বপ্নের করুণ সমাপ্তি। পার্নিয়ার মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যুদ্ধ শুধু রণক্ষেত্রের নয়, যুদ্ধ আসে ঘরে, হৃদয়ে। এটি এমন এক ছায়া, যা শিশুদের শৈশব কেড়ে নেয়, মায়েদের কোল খালি করে, কবিদের কলম চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়।
পার্নিয়ার কবিতায় ছিল ইরানি নারীর যন্ত্রণার কথা। স্বাধীনতার তৃষ্ণা, আর আত্মার স্বাতন্ত্র্য। এক পঙক্তিতে তিনি বলেছিলেন, “যেখানে আমি তোমাকে খুঁজে পাব, যেখানে কোনো পথ নেই।” সেই পথহীন যাত্রাতেই আজ তিনি পাড়ি দিয়েছেন। যেখানে আর কোনো শব্দ নেই, আছে শুধু নীরবতা।
তার বাবা পারভিজ, মা মাসৌমেহ, আর ছোট ভাই পারহাম একের পর এক শোকের ঢেউয়ে দিশেহারা। একটি স্বপ্নময় পরিবারের গল্প নিমেষে হয়ে উঠেছে একটি বেদনার ইতিহাস। যুদ্ধের এমন নির্মমতা কেবল সামরিক লক্ষ্য নয়, হৃদয়েরও বিনাশ ঘটায়।

পার্নিয়া আব্বাসি, ছবি ; দ্যা অবজারবার পোস্ট।
পার্নিয়া ও বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসি
পার্নিয়ার নামের সঙ্গে ইরানের বিখ্যাত পারমাণবিক বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসির নামের মিল থাকায়, কিছু মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতে দাবি করা হয় যে তিনি বিজ্ঞানী আব্বাসির মেয়ে। কিন্তু পার্নিয়ার পরিবার ও বন্ধুরা এই দাবি অস্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, পার্নিয়ার পুরো নাম আব্বাসি আরিমি। তার সঙ্গে ফেরেইদুন আব্বাসির কোনো সম্পর্ক নেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই ভুল ধারণা পার্নিয়াকে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসির মেয়ে বলে প্রচার করেছে। অথচ তার জীবন ছিল একজন সাধারণ, নিরীহ তরুণীর। যিনি চেয়েছিলেন শুধু কবিতা লিখতে, ভালোবাসতে, জীবনকে স্পর্শ করতে। এই ভুল পরিচয়, এই রাজনৈতিক বিভ্রান্তির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে তার আসল পরিচয়। তিনি ছিলেন পার্নিয়া আব্বাসি, এক কবি, এক স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন প্রেমিকা, একজন মেয়ে।
তার বন্ধুরা বলছেন, কেউ যেন ভুলে না যান, যেন তার লেখা কেউ পড়ে, মনে রাখে। কারণ পার্নিয়া কেবল একজন মানুষ ছিলেন না, ছিলেন একজন মানবিক বোধের প্রতীক।
আজ পার্নিয়ার গল্প আমাদের শেখায়, যুদ্ধ কখনো কেবল রাজনীতির খেলা নয়। এটি এক তরুণী কবির হাসিকে থামিয়ে দিতে পারে। এক পরিবারের ভবিষ্যৎকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। এই যুদ্ধ এবং সংঘাত আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়, এই সব কিছুর বিনিময়ে আদতে কী অর্জিত হয়?
পার্নিয়ার নামটি যেন সময়ের সঙ্গে হারিয়ে না যায়। যেন তার কবিতা মনে গেঁথে থাকে শান্তির চিরন্তন আহ্বান হয়ে। শান্তির জন্য তার শব্দ, তার জীবন, তার চাওয়া, এইসবই হোক আমাদের বিবেকের অন্তর্গত দীপ্তি।
পার্নিয়া আব্বাসি নেই। কিন্তু তার কবিতা, তার স্বপ্ন, তার জীবনদর্শন থেকে আমাদের শেখার আছে, মানবতা ও শান্তি ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
সূত্র – দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট