এক সময় মনে করা হতো, চুল পড়া বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে বয়সের কারণে ঘটে। টাক পড়া শুরু হবে পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশের পর। কিন্তু এখন বাস্তবতা অনেকটাই বদলে গেছে। ত্রিশের আগেই অনেক তরুণ-তরুণীই চুল পড়া সমস্যায় ভুগছেন। ফ্যাশন সচেতন, কর্মব্যস্ত এই প্রজন্মের জন্য এটি শুধু স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয় বরং আত্মবিশ্বাসেরও বড় ধাক্কা। কিন্তু কেন এই সমস্যা বেড়ে চলেছে?
এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন এভার কেয়ার হাসপাতালের কনসালটেন্ট, ডার্মাটোলজি এবং ভেনোরোলজি বিভাগের প্রফেসর ডাঃ হাসিবুর রহমান।
চুলপড়া কিংবা টাক হয়ে যাওয়া একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে নির্দিষ্ট নকঁশাকারে চুল পড়ার ধরণটি বংশগতির সাথে সম্পর্কিত। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নিজেও এর জন্য দায়ী।
চুল পড়া বিষয়টি সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ধরনের সাথে জড়িত। রাতজাগা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা এবং হতাশাজনক জীবনযাপন চুল পড়ার একটি অন্যতম কারণ।
বিভিন্ন ধরনের হেয়ার স্টাইলের কারণেও চুল পড়ে। চুলে জেল দেয়া, আয়রন কারলিং, পারলিং এসব করলেও বেশি পরিমাণে চুল পড়ে যায়।
পুষ্টি একটা বিরাট ফ্যাক্টর। ফাস্টফুডে প্রচুর ফ্যাট ও সুগার থাকে। আর এ যুগের ছেলে-মেয়েরা বেশি পরিমানে ফাস্টফুড, সফট ড্রিংকস খায়। যার ফলে টিনেজদের চুলপড়ার প্রবণতাও বেশি দেখা যায়।

ত্রিশের আগেই অনেক তরুণ-তরুণীই চুল পড়া সমস্যায় ভুগছেন, ছবি: ফিলিপ কিংস লে
শরীরের ওজন কমাতে এখন ডায়েটিং এর দিকে অনেকেই ঝুঁকছেন। যা চুলপড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম। এ ক্ষেত্রে নিউট্রোশনাল ডেফিসিয়েন্সি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে প্রোটিনের ঘাটতি। এগুলো চুল পড়ার অন্যতম কারণ। চুলের বেশিরভাগ হলো প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেড ও পানি দিয়ে গঠিত। চুলের প্রায় ৯০% হচ্ছে প্রোটিন। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল জাতীয় খাবার খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দেয়া চুল পড়ার কারণ।
ধূমপান চুল পড়ার হার বাড়িয়ে দেয়। ধূমপান বড় বড় রক্ত নালিকে বন্ধ করে দেয়। আর চুলের গোড়ায় অতিসুক্ষ্ম রক্তনালী থাকে। ধূমপানের কারণে এই রক্তনালীগুলো বন্ধ হয়ে যায়। চুলের পুষ্টি আসে রক্তের মাধ্যমে তাই রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে চুল পড়ে যাবে।
ঘনঘন শ্যাম্পু করলে চুল পড়ে। চুল প্রোটিন দিয়ে তৈরি। আর শ্যাম্পু ক্ষার দিয়ে তৈরি। ক্ষার ও প্রোটিন একত্রিত হলে প্রোটিন ভেঙে যায়। এতে চুল গোড়া থেকে ঠিক থাকলেও সামনের অংশ ভেঙে পড়ে।
হরমোন ও থাইরয়েড জনিত সমস্যার কারণেও চুল পড়ে। আবার থাইরয়েডের চিকিৎসার জন্য যে ঔষধ দেয়া হয় সেটার কারণেও চুল পড়ে।

অতিরিক্ত চুল পড়ার অন্যতম কারণ হলো খুশকি, ছবি: হেলথ লাইন
তাপমাত্রা চুল পড়ার একটি প্রধান কারণ। পরিবেশের ভিন্ন তাপমাত্রার কারণে মাথার স্ক্যাল্প গরম হয়ে যায়। স্ক্যাল্পে ঘাম জমে এ কারণেও অধিক হারে চুল পড়ে।
বাসাবাড়ির পানির ট্যাঙ্কিতে বেশি মাত্রায় ক্লোরিন বা ব্লিচিং পাউডার থাকে। এটাও চুল পড়ার অন্যতম কারণ।
মাথায় যদি কারও স্ক্রিন ডিজিজ হয়। বড়দের যেমন স্যাভোরিক অ্যাক্সিমা, সোরিয়াসিস এসব ডিজিজ হলে চুল পড়ে যায়।
অতিরিক্ত চুল পড়ার অন্যতম কারণ হলো খুশকি। খুশকি হয় মাথার ত্বকের উপরের অংশে। মাথার ত্বকের উপরিভাগের ঝরে পড়া মৃত কোষ খুশকির মূল উপাদান। মাথার ত্বকের মৃত কোষ ঝরে প্রতিনিয়ত নতুন কোষ তৈরি হয়। ফলে এসব মৃত কোষ খুব বেশি জমে যায়।
মানসিক দুশ্চিন্তা থেকেও খুশকি হয়। হতাশা কিংবা মানসিক চিন্তা থেকে মাথার ত্বক শুকিয়ে যাবার আশঙ্কা বেড়ে যায়। অনিয়মিত পরিচর্যা ও অবহেলায় মাথার ত্বকে খুশকির পরিমাণ বেড়ে ছত্রাকের সৃষ্টি হয়। ফলে ত্বকে ঘা-সহ নানা রোগ দেখা দেয়। এ ছাড়া খাদ্যাভ্যাসের কারণে খুশকি হতে পারে। মূলত ভিটামিন বি ও জিংকের অভাবে খুশকি হয়।

বিভিন্ন ধরনের হেয়ার স্টাইলের কারণে চুল পড়ে যায়, ছবি: উইমপুল ক্লিনিক
ম্যালেসেজিয়ানামের এক ধরনের ছত্রাক খুশকির কারণ। এ ছত্রাক সবার ত্বকেই কমবেশি থাকে। কিন্তু এটির পরিমাণ ত্বকে বেশি হলে তা ত্বক শুষ্ক করে তোলে। ফলে খুশকির সৃষ্টি হয়। আবার ত্বকের নানা সমস্যায় ও কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় খুশকি হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদেরও খুশকি হতে পারে।
চুল পড়া রোধে চিকিৎসকের পরামর্শ
এক্ষেত্রে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা খুব দরকার। এজন্য রাত না জেগে দ্রুত ঘুমিয়ে পরতে হবে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করতে হবে।
মানসিক দুশ্চিন্তা, হতাশা কমাতে হবে। যতটা সম্ভব আনন্দে ও প্রাণবন্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
নিউট্রিশনাল ডেফিসিয়েন্সি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে প্রোটিনযুক্ত খাবার মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল জাতীয় খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
তেল চুলের সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ দেয়ালে রং করলে দেয়ালের সৌন্দর্য্য যেমন বৃদ্ধি পায়। সাথে দেয়ালকে সুরক্ষিত রাখে। তেমনি চুলের ক্ষেত্রে তেল একইভাবে চুলকে গোড়া থেকে মজবুত করে। চুল পড়া কমায়।

চুল পড়া রোধে ভালো মানের শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে, ছবি: হেয়ার শিউর
খুশকি গোড়াতেই নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। খুশকি কেন হচ্ছে জানার চেষ্টা করতে হবে। যারা নিয়মিত বাইরে যান বা ধূলাবালিতে চলাফেরা করেন, তাদের নিয়মিত চুল পরিষ্কার রাখা আবশ্যক।
যেহেতু মানুষের ত্বক ও চুল খুবই স্পর্শকাতর। তাই এগুলোর জন্য মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রী ব্যবহার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, তেল, সাবান, সিরাম নিম্ন মানের ব্যবহারে বিরত থাকতে হবে। নানা ধরনের শ্যাম্পু, হেয়ার ড্রায়ার, রিবন্ডিং, হেয়ার জেল ব্যবহার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে একদিন পরপর সফট জেন্টেল শ্যাম্পু ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
যাদের থাইরয়েড সমস্যা, ডায়াবেটিস, রক্তে আয়রন এবং ভিটামিন ডি এর পরিমাণ কমবেশি আছে। তারা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট হিসেবে বায়োটিন, ক্যালসিয়াম, ফলিক এসিড, ভিটামিন সি ও ডি এবং জিংক নেবেন। যা তিন থেকে চার মাসের মধ্যে রিকভার করে। যেসব ক্ষেত্রে রিকভার হয় না সে ক্ষেত্রে অনেক চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে থেকে ডার্মারোলার অলমাইক্রোনিউক্লিন থেরাপি, পিআরপি (প্লেটিলেজরিচপ্লাজমা) থেরাপি দেয়া হয় বলে তিনি জানান। যা বর্তমান বিশ্বের একটি জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি।

চুল পড়া রোধে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে, ছবি: ক্লিনিক্যালি ডটকম
পরিবারের কারও মাথায় খুশকি থাকলে তার ব্যবহৃত তোয়ালে বা চিরুনি ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ একবার খুশকি সেরে গেলে এবং মাথার তালু ফাঙ্গাস মুক্ত হলে আবার চুল গজাবে। এ ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শে খুশকি প্রতিরোধী ওষুধ ও অ্যান্টি ফাঙ্গাল শ্যাম্পু ব্যবহার করুন।
চুলপড়া রোধে রূপ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
চুল পড়া রোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ বিউটি কেয়ারের রূপ বিশেষজ্ঞ শারমিন কচি বলেন, যে কোনো সমস্যার একেবারে গোড়াতেই নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। কি কারণে চুল পড়ছে তা শুরুতে জেনে সেই অনুযায়ী যত্ন নিতে হবে। আর চুল পড়া রোধের প্রথম শর্ত হচ্ছে শরীরের ভেতর ও বাইরে উভয়দিক থেকে যত্ন নেয়া। চুল পড়া রোধে তিনি কিছু ঘরোয়া পরামর্শ দিয়েছেন।
চুল পড়া বন্ধে পেঁয়াজের রস দারুণ কাজ করে। শুধু চুল পড়া বন্ধ হবে তাই নয়, নতুন চুল গজাতেও পেয়াজের রস কার্যকরী। গোসলের এক ঘণ্টা আগে পেঁয়াজের রস চুলের গোঁড়ায় ঘষে ঘষে লাগান। এরপর ভেষজ শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।

নিয়মিত চুলের যত্নের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে, ছবি: ক্লিনিক্যালি ডটকম
চুলের গোঁড়ায় আমলকির তেল ঘষে ঘষে লাগান। আধা ঘণ্টা রাখুন, তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। আধা কাপ মেথি সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে বেটে চুলে লাগান। ১ ঘণ্টা পর মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
ডিমের কুসুম ভালো করে ফেটিয়ে নিন। চুলের গোঁড়ায় তা লাগান। এরপর ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। নারকেল তেল সামান্য গরম করে চুলের গোঁড়ায় ম্যাসাজ করুন। ১ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলুন।
ঘরোয়া প্যাকগুলো সপ্তাহে ২-৩ দিন নিয়ম মেনে চর্চা করলে চুল পড়া কমবে।
বয়স ত্রিশের আগেই চুল পড়া নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়, কিন্তু একে থামানো সম্ভব। সচেতনতা ও যত্ন থাকলে চুল পড়া কমিয়ে সুস্থ, ঘন ও ঝলমলে চুল ফিরিয়ে আনা সম্ভব।