দিনের শুরুতে চায়ের কাপে প্রথম চুমুক যেন জাগিয়ে তোলে শরীর ও মনকে। অথচ আমরা ক’জন ভেবে দেখি, এই চায়ের আছে একটি আন্তর্জাতিক দিবস—বিশ্ব চা দিবস, যেটি পালিত হয় ২১ মে। কিন্তু কেন এই দিন? কী তার পেছনের ইতিহাস? আর কীভাবে চায়ের পাতাটি হয়ে উঠলো বিশ্বের এত মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ?
চলুন, ফিরে যাই ইতিহাসের পাতায়—চায়ের পাতার গল্প শুনতে।
পাতা থেকে পরম্পরা
শুরু হয় প্রায় ৫০০০ বছর আগে, চীনে। কিংবদন্তি অনুসারে, চীনা সম্রাট শেন নাং একদিন গরম পানি পান করছিলেন, হঠাৎ করে কিছু বুনো গাছের পাতা সেই পানিতে পড়ে যায়। সেই পানীয়ের রং ও ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে তিনি সেটি পান করেন—এবং এখান থেকেই শুরু চায়ের যাত্রা।
ক্রমে এই চা ছড়িয়ে পড়ে জাপান, ভারতবর্ষ, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। সময়ের সাথে সাথে, শুধু পানীয় নয়, চা হয়ে ওঠে রাজনীতি, ব্যবসা, উপনিবেশবাদ এবং সাংস্কৃতিক সংযোগের প্রতীক।

চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া চা একসময় ইংরেজদের হাত ধরে প্রবেশ করে আমাদের দেশে, এই চা বাগানের ছবিটি হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া থেকে চা বাগান থেকে তোলা হয়েছে, ছবি: শরীফ মাহমুদ
একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতা
বিশ্বের বহু দেশে চা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, চীন—এসব দেশের চা-বাগানগুলোতে কর্মরত শ্রমিকেরা অতিদীর্ঘ সময় কাজ করেও পান নগণ্য মজুরি ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
এই অবিচারের প্রতিবাদ জানাতেই উঠে আসে একটি প্রশ্ন—তাদের অবদানের স্বীকৃতি কোথায়?
বিশ্ব চা দিবস কবে শুরু হলো?
২০০৫ সালে, দিল্লিতে প্রথমবারের মতো “আন্তর্জাতিক চা দিবস” পালিত হয় ১৫ ডিসেম্বর। মূলত ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, উগান্ডা ও কেনিয়াতে এটি পালিত হতো—চা শ্রমিকদের অধিকার ও চা শিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরতে। কিন্তু এটি ছিল সীমিত কিছু অঞ্চলে পালিত একটি দিবস। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব ছিল।
জাতিসংঘের স্বীকৃতি ও নতুন তারিখ
চায়ের বৈশ্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে, ২০১৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ২১ মে-কে বিশ্ব চা দিবস হিসেবে। ২০২০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। এই দিনটি বেছে নেওয়ার কারণ—এ সময়েই অধিকাংশ চা উৎপাদনকারী দেশে নতুন চা পাতা তোলার মৌসুম শুরু হয়। এটা চা শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।

চা দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য চা উৎপাদনে জড়িত কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানানো, ছবি: শরীফ মাহমুদ
দিবসটির উদ্দেশ্য
বিশ্ব চা দিবস শুধুমাত্র চা উদযাপনের জন্য নয়। এর মূল উদ্দেশ্য—
- চা উৎপাদনে জড়িত কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানানো
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি
- চা শিল্পের টেকসই উন্নয়নের আহ্বান
- ভোক্তা ও উৎপাদকের মধ্যে ন্যায্য বাজারনীতি প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
বাংলাদেশও বিশ্বের অন্যতম চা উৎপাদনকারী দেশ। সিলেট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ, পঞ্চগড়—চা-বাগান ছড়িয়ে আছে সবখানে। প্রায় ২ লক্ষ চা শ্রমিক এই খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বিশ্ব চা দিবস আমাদের কাছে শুধু চায়ের ঐতিহ্য নয়—এটি একটি শ্রমজীবী শ্রেণির স্বপ্ন, অধিকার ও টিকে থাকার গল্প।
চায়ের কাপেই পৃথিবীর গল্প
চায়ের পাতাটি একটি বীজের মতো—যে শুধু মাটিতে জন্মায় না, জন্ম দেয় ভাবনার, সংযোগের, ইতিহাসের। বিশ্ব চা দিবস তাই কেবল চায়ের স্বাদে উদযাপন নয়, বরং চা উৎপাদক, সংগ্রাহক, পরিবেশক এবং উপভোক্তার এক যৌথ চেতনার দিন। যখন আপনি আগামীবার এক কাপ চা হাতে নেবেন, হয়তো একটুখানি মনে পড়বে—এই পাতার পেছনে রয়েছে একটি মানুষের ঘাম, একটি দেশের ইতিহাস, এবং একটি দিনের দাবি—২১ মে, বিশ্ব চা দিবস।