জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া-দাওয়ার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু অতিরিক্ত বা ভারসাম্যহীন খাদ্যাভ্যাস শরীরে নানা ধরনের রোগের জন্য দায়ী। এসব রোগ থেকে মুক্তি পেতে বা প্রতিরোধ করতে স্বাস্থ্যকর ও টেকসই ডায়েটের জুরি মেলা ভার। বর্তমান সময়ে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ নানা ধরনের ডায়েট অনুসরণ করে থাকেন। এদের মধ্যে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (Intermittent Fasting) বেশ জনপ্রিয়।
ওজন কমানো ও সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী একটি পদ্ধতি। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং, এমন এক খাদ্যাভ্যাস যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাবার খাওয়া হয় আর বাকি সময় উপবাস করা হয়। এটি শুধু ওজন কমানোর জন্য নয়, বরং শরীরের বিপাকক্রিয়া উন্নত করা, হৃদ রোগের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি দীর্ঘায়ুর জন্যও কার্যকর বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং শুরু করার আগে ধাপে ধাপে অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত, ছবি: ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং-এর বিজ্ঞান
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং-এর দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা হয়। এ সময় শরীরে ‘অটোফেজি’ শুরু হয়। অটোফেজি হল শরীরের কোষের একটি প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতা প্রক্রিয়া, যেখানে পুরনো, ক্ষতিগ্রস্ত বা অকার্যকর কোষ পুনঃব্যবহারযোগ্য অংশে ভেঙে ফেলা হয় আর নতুন কোষ গঠনের জন্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। উপবাসের সময় ইনসুলিনের স্তর কমে যায়, যা কোষকে অটোফেজি প্রক্রিয়া শুরু করতে উদ্দীপিত করে।
দীর্ঘস্থায়ী উপবাস (১২-১৬ ঘণ্টা বা তার বেশি) এই প্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে পারে, যা শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সহায়তা করে। অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে ২০১৬ সালে জাপানি সেল বায়োলজিস্ট ইওশনরি ওশুমি চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পান। মূলত এরপর থেকে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ এই ডায়েট নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বিভিন্ন ধরণের হতে পারে, যার মধ্যে কয়েকটি প্রধান পদ্ধতি হলো-
১৬:৮ পদ্ধতি – দিনে ১৬ ঘণ্টা উপবাস রেখে বাকি ৮ ঘণ্টার মধ্যে খাবার গ্রহণ করা হয়।
৫:২ পদ্ধতি – সপ্তাহে পাঁচ দিন স্বাভাবিক খাবার খাওয়া হয় এবং দুই দিন কম ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা হয়।
ওয়ান-মিল-এ-ডে (OMAD) – প্রতিদিন মাত্র একবার খাবার খাওয়া হয়, যা সাধারণত ২৩:১ সময়সূচির মধ্যে পড়ে।
আল্টারনেট ডে ফাস্টিং – এক দিন স্বাভাবিক খাবার খাওয়া হয় এবং পরের দিন উপবাস পালন করা হয় বা খুব কম ক্যালরি গ্রহণ করা হয়।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং উপকারিতা
- এটি দেহের ইনসুলিন মাত্রা কমিয়ে ফ্যাট বার্নিং প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে, ফলে সহজেই ওজন হ্রাস পায়।
- উপবাস থাকার ফলে পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম পায় এবং হজমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
- ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
- এটি কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে।
- ব্রেইনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, আলঝেইমারসহ বিভিন্ন নিউরোলজিক্যাল সমস্যার ঝুঁকি কমায়।
- এটি কোষের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে, যা আয়ু বৃদ্ধিতে সহায়ক।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং সুস্বাস্থ্যের এক যুগান্তকারী উপায়, ছবি: বিবিসি
ধাপে ধাপে অভ্যাস গড়ুন
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং শুরু করার আগে ধাপে ধাপে অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। প্রথমে ১২ ঘণ্টা উপবাসের মাধ্যমে শুরু করে ধীরে ধীরে ১৬:৮ বা অন্যান্য পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হওয়া যেতে পারে। এ সময়ে পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি পরিহার করতে হবে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, প্রক্রিয়াজাতকৃত ও চিনিযুক্ত খাবার। মনোযোগ থাকতে হবে ঘুমের রুটিনের দিকেও। দিনে অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।
সাবধানতা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও এটি বেশ কার্যকর, তবে যাদের ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, কম রক্তচাপ বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এই খাদ্যাভ্যাস শুরু করা উচিত। ২৫ বছরের কম বয়সী, রক্তস্বল্পতা, উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপের রোগী, গর্ভবতী ও বুকের দুধ পান করানো মায়েদের এই ডায়েট এড়িয়ে যেতে হবে।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং সুস্বাস্থ্যের এক যুগান্তকারী উপায়। সঠিক নিয়ম মেনে এটি অনুসরণ করলে দেহ ও মনের জন্য অসংখ্য উপকারিতা পাওয়া সম্ভব। তবে ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত পদ্ধতি নির্বাচন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।