Home সর্বশেষ রহস্যে মোড়ানো অ্যামাজন 

রহস্যে মোড়ানো অ্যামাজন 

রবিউল্লাহ
১৫৮ views

রহস্য, রোমাঞ্চ আর রোমহর্ষক সব মুহুর্তে যেন এক অন্য পৃথিবী! হাতছানি দিয়ে প্রতিনিয়ত ডেকে যায় বাইরের পৃথিবীর কেতাদুরস্ত নাগরিকদের। জীববৈচিত্রে ভরপুর পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অরণ্য অ্যামাজন-এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে রহস্য আর বিস্ময়। কী নেই এই অরণ্যে! এ যেন পৃথিবীর ভেতর আরেক পৃথিবী!

দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদী বিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত বিশাল এ বনভূমি। ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরণ্য দক্ষিণ আমেরিকার ৯টি দেশজুড়ে বিস্তৃত। অ্যামাজন অরণ্যের ৬০% ব্রাজিলে, ১৩% পেরুতে এবং বাকি অংশ কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম ও ফরাসি গায়ানাজুড়ে বিস্তৃত।

পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত অ্যামাজনের চিরহরিৎ বন থেকে। আয়তনে এই অরণ্য বাংলাদেশের তুলনায় ৩৮ গুণ বড়। 

আমাজান এনাকুন্ডা

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর সাপ অ্যানাকোন্ডা অবাধে ঘুরে বেড়ায় এই অরণ্যে,ছবি: ফ্রিপিক

অ্যামাজনের গাছপালা ও জীবজন্তু

অ্যামাজনের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন উদ্ভিদ। হাজার হাজার প্রজাতিতে বিভক্ত এই উদ্ভিদের অনেক প্রজাতিই বাইরের পৃথিবীতে বিরল। এ অরণ্যের বেশির ভাগই চিরহরিৎ বৃক্ষ। তাই অ্যামাজনকে চিরহরিৎ বনও বলা যায় অনায়াসে। অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে যেসব রেইনফরেস্ট রয়েছে তার অর্ধেকটাই দখলে রেখেছে অ্যামাজন। তাই একে রেইন ফরেস্টও বলা হয়। তবে অ্যামাজনকে রেইনফরেস্ট বলা হলেও এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়। বরং রেইনফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আদ্রতা, বৃষ্টিপাত ও উঞ্চ আবহাওয়ার কারণে।

অ্যামাজনে আছে ৮৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ। এসব প্রাণীদের মধ্যে দেখতে যেমন সুন্দর ও নিরীহ প্রাণী আছে, তেমনি আছে ভয়ংকর সব প্রাণী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর সাপ অ্যানাকোন্ডা অবাধে ঘুরে বেড়ায় এই অরণ্যে। এছাড়া রয়েছে লাল চোখা ব্যাঙ, জাগুয়ার, বানর, বৈদ্যুতিক ইল, পিরানহা, বিষাক্ত ডার্ট ফ্রগসহ অসংখ্য বিষাক্ত জাতের সাপ ও সরীসৃপ প্রাণী।

আমাজানের বাঘ

অ্যামাজন অরণ্যে অন্যান্য প্রাণীদের মতো অবাধে বিচরণ করে বাঘও ,ছবি:ফ্রিপিক

 অ্যামাজনের ফুটন্ত নদী

অ্যামাজনের আরেক বিস্ময় এই অরণ্যের ফুটন্ত নদী। অ্যামজনের পেরু সংলগ্ন অংশে অবস্থিত এই নদীর পানি ফুটছে বিরতিহীন। তাই এই নদীটি ফুটন্ত নদী নামে বিশেষভাবে পরিচিত। ২০১১ সালে ভূতত্তবিদ আন্দ্রে রুজো অ্যামাজনের এই ফুটন্ত নদী আবিষ্কার করেন। নদীটি আবিষ্কার করতে কঠোর পরিশ্রম করেন এ বিজ্ঞানী। এটি মায়ানতুয়াকু নদী নামেও পরিচিত। আন্দ্রে রুজো ছোটবেলায় তার দাদুর কাছ থেকে ফুটন্ত নদীর গল্প শুনেছেন অনেক। তাই নিশ্চিত ছিলেন, লোককাহিনীতে যদি এমন নদীর উলে­খ থাকে তবে বাস্তবেও ফুটন্ত নদী থাকাটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য অন্য বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল অ্যামাজনে এমন কোনো নদী থাকতেই পারে না। কারণ এ অরণ্য জীবন্ত আগ্নেয়েগিরি থেকে অনেক দূরে। তবু অনুসন্ধানে বের হন আন্দ্রে। অ্যামাজনের গভীরে চার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত এই নদীর হদিশ একদিন ঠিকই খুঁজে পান তিনি। পেরুর জনজাতি আশানুনকা ওই নদীর পাশে বসতি স্থাপন করেছিল বহু আগেই। মায়ানতুয়াকু নামটা তাদেরই দেওয়া। তারা এই নদীকে বেশ পবিত্র মনে করেন। আন্দ্রে জানান, এই নদীর পানি এতটাই উঞ্চ যে এক মিনিট ডুবিয়ে রাখলে আঙুল পুড়ে যেতে পারে।

অ্যামাজনের বুকে নদী

অ্যামজনের পেরু সংলগ্ন অংশে অবস্থিত এই নদীর পানি ফুটছে বিরতিহীন ,ছবি:ফ্রিপিক

অ্যামাজনের স্বর্ণ শহর

স্বর্ণের শহর! অ্যামাজনের এই ‘এল ডোরাডো’ বা ‘স্বর্ণ শহর’কে ঘিরে রয়েছে নানা উপাখ্যান আর কল্পকাহিনী। স্প্যানিশ ভাষায় এল ডোরাডো মানে ‘যেটি স্বর্ণ’। এ নামটি এসেছে এল অমব্রে দোরাদো ((El Hombre Dorado)) বা ‘স্বর্ণ মানুষ’ থেকে। অনেক দিন আগে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় ‘মুইসকা’ আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস ছিল। কথিত আছে মুইসকা ঐতিহ্য অনুসারে, নতুন রাজা নির্বাচন করার পর মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্বর্ণের গুঁড়ো মাখিয়ে তাকে পবিত্র স্নান করানো হতো। এদের বলা হতো এল ডোরাডো। কালক্রমে এটি হয়ে যায় এক হারিয়ে যাওয়া শহরের নাম। যে শহরের সবটুকুই নাকি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি! আর এভাবেই এক কিংবদন্তী শহর হয়ে উঠল এল ডোরাডো বা স্বর্ণ শহর।

মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো বলেছিলেন, ‘এল ডোরাডো যেতে চাও, তবে চাঁদের পাহাড় পেরিয়ে, ছায়ার উপত্যকা ছাড়িয়ে, হেঁটে যাও, শুধু হেঁটে যাও’। ১৫৪১ সালে এই স্বর্ণ শহরের খোঁজে অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো দে ওরেয়ানা আর গনসারো পিসারো অভিযানে বেরিয়েছিলেন। অ্যামাজন নদীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে পুরো দৈর্ঘ্যটাই জানা হয়ে যায় ওরেয়ানার।

২০০১ সালে রোমের এক পাঠাগারে হঠাৎ এক ধুলোমাখা নথি আবিষ্কৃত হয়। আন্দ্রিয়া লোপেজ নামের এক ধর্মযাজক ১৭ শতকে সেই নথি লিপিবদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। যে নথিতে উল্লেখ আছে নানা মিথে ভরপুর স্বর্ণ শহরের কথা। আর সেই শহরের অঢেল ধন-সম্পত্তির কথা।

অ্যামাজনে শহর

অ্যামাজনের এই ‘এল ডোরাডো’ বা ‘স্বর্ণ শহর’কে ঘিরে রয়েছে নানা উপাখ্যান আর কল্পকাহিনী, ছবি:ফ্রিপিক

এল ডোরাডো বা স্বর্ণ শহরের সন্ধান পেতে গত ১০০ বছরে নানা দেশের সংগঠিত অভিযানই হয়েছে অন্তত ১৪টি। এসব অভিযানে ইনকা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেলেও দেখা মেলেনি সেই স্বর্ণ শহরের। ১৯৭১ সালে গহীন জঙ্গলে স্বর্ণ শহরের খোঁজে বেরিয়ে এমনিভাবে হারিয়ে গেছেন ফরাসি ও মার্কিন একদল অভিযাত্রী।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রত্নতাত্তিকদের ধারণা, দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ রেইনফরেস্ট আর পার্বত্য অঞ্চলের কোনো এক এলাকায় এ স্বর্ণ নগরীর খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। মাচুপিচু আবিষ্কার যখন হয়েছে, তাহলে একদিন স্বপ্নের স্বর্ণ শহর এল ডোরাডোও আবিষ্কার হবে। সে আশায় বুক বেঁধেছেন অসংখ্য অভিযাত্রী। 

অ্যামাজন অরণ্যের বাসিন্দা

অ্যামাজন অরণ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বসবাস। এই বনে এমন জাতিসত্তার সংখ্যা তিনশর বেশি। এদের বেশির ভাগই ব্রাজিলীয়। পর্তুগিজ, স্প্যানিশসহ অন্যান্য ভাষায় তারা ভাবের আদান-প্রদান করেন। তবে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা। কিছু যাযাবর জাতিও বসবাস করেন এই অরণ্যে। অ্যামাজনের বাইরে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে এখানকার এই মানুষগুলোর তেমন কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে।

অ্যামাজনে মানুষ

অ্যামাজনের বাইরে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে এই মানুষগুলোর তেমন কোনো যোগাযোগ নেই, ছবি:ফ্রিপিক

এই মানুষরা পৃথিবীর সভ্য মানুষের মতো পোশাক পরেন না, খাবার খান না। গাছের পাতা আর ছাল-বাকলে তৈরি তাদের পোশাক। গহীন অরণ্যে শিকার করে তারা তাদের খাবার সংগ্রহ করেন। পৃথিবীর সভ্য মানুষদের সঙ্গে বিস্তর ফারাক বলে তাদের অসভ্য বলে খারিজ করে দেওয়ারও সুযোগ নেই। প্রকৃতির সঙ্গে, মাটির সঙ্গে তারা তাদের জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন এক অন্য ছন্দে। অ্যামাজন অরণ্যই তাদের পৃথিবী, অ্যামাজনই তাদের জীবন।

 লেখক : কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ