বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। তার সম্পদের পরিমাণ ২০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এখন তিনি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি অ্যামাজন এক সময় ছিল অনলাইনে পুরোনো বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান। আর এখন তা হতে যাচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়ন-ডলার কোম্পানি, অর্থাৎ তার মূল্য হবে এক লাখ কোটি ডলার।
অ্যামাজনে কেনা যায় না সারা দুনিয়ায় এমন কিছুই এখন নেই। পোষা বেড়ালের খাবার থেকে শুরু করে বহুমূ্ল্য ক্যাভিয়ার— সবই কেনা যায় অ্যামাজনে, বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে। শুধু তাই নয়, অ্যামাজনের আছে স্ট্রিমিং টিভি। এমন কি রয়েছে নিজস্ব অ্যারোস্পেস কোম্পানি, যাতে শিগগিরই মহাশূন্যে ভ্রমণের টিকিট পাওয়া যাবে।
জেফ বেজোস কীভাবে এই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছালেন? সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইকোনমিক ক্লাব অব ওয়াশিংটন ডিসিতে দেওয়া এক বক্তৃতায় নিজের সাফল্যের পেছনের রহস্য জানিয়েছেন তিনি।
সকালে নিজের জন্য এক ঘণ্টা
প্রতিদিন সকালে নিজের জন্য এক ঘণ্টা সময় আলাদা রাখেন জেফ বেজোস। এ সময় স্মার্টফোনসহ সব ধরনের ইলেকট্রনিকস যন্ত্র দূরে রেখে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করেন।

আমেরিকার প্রযুক্তি, খুচরা উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, সমাজসেবী ও অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, ছবি: এনপিআর ডট ওআরজি
জেফ বেজোস মনে করেন, এই অভ্যাস তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা উন্নত করেছে। তার মতে, সকালের এই অভ্যাসের কারণে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলোয় প্রাণবন্তভাবে অংশগ্রহণ করা যায়।
এ বিষয়ে বেজোস বলেন, আমি আমার প্রথম বৈঠক সকাল ১০টার জন্য নির্ধারণ করি। কারণ, বেশি মেধা দিতে হয়— এমন বৈঠক আমি দুপুরের খাবারের আগে করতে পছন্দ করি। বিকেল পাঁচটার দিকে আমি আর সমস্যা সম্পর্কে বেশি ভাবতে পারি না। পরের দিন সকাল ১০টায় আবার চেষ্টা করি।
ধীরগতিতে সকাল শুরু
আমি ধীরগতিতে সকাল শুরু করি। আমি ততটা সৃজনশীল নই, যতটা সবাই মনে করেন। সকালে উঠে হাঁটার পাশাপাশি আমি প্রতিদিনই ব্যায়াম করি। তবে দিনের প্রথম কয়েক ঘণ্টা বেশ ধীরে চলাফেরা করে থাকি, যোগ করেন তিনি।
২০২০ সালে ইনভেন্ট অ্যান্ড ওয়ান্ডার নামের একটি বই প্রকাশ করেন। জেফ বেজোস সেখানে নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, আমি ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠি, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাই। আমার আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। এতে আমি ভালো চিন্তা করতে পারি। আমি বেশি শক্তি পাই। মন-মেজাজও ভালো থাকে।
যেভাবে এত ধনী হলেন
তিনি যেন নিজেই জানতেন তার ভবিষ্যৎ। তার গল্প শুনলে মনে হয় যেন জেফ বেজোসের হাতে একটা ক্রিস্টাল বল ছিল, যাতে তিনি তার নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন।
মাত্র দু,দশক আগেও তিনি ছিলেন সাধারণ এক উদ্যোক্তা। কিন্তু তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এমন এক যুগ আসছে যখন কম্পিউটারের এক ক্লিকেই যেকোনো জিনিস কেনা যাবে, শপিংমলের জনপ্রিয়তা কমে যাবে, দোকানগুলো ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য নানা রকমের ‘অফার’ দিতে বাধ্য হবে।

ধনকুবের জেফ বেজোসের ও তার সাবেক স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি স্কট, ছবি: হ্যালো ম্যাগাজিন
জেফ বেজোসের ছিল সেই উচ্চাভিলাষ, অন্তর্দৃষ্টি আর ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারার ক্ষমতা, যা হয়তো সবার থাকে না এবং সেটা বোঝা গিয়েছিল কয়েক দশক আগেই।
তার জন্ম ১৯৬৪ সালে, তখনও তার বাবা-মায়ের বয়স ১৯ পেরোয়নি। দ্রুতই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর তিনি বড় হন তার মা জ্যাকি আর দ্বিতীয় স্বামী মাইক বেজোসের ঘরে। এই মাইক বেজোস তখন চাকরি করতেন এক্সন কোম্পানিতে। তার আসল দেশ কিউবা, কিন্তু ফিদেল ক্যাস্ট্রো ক্ষমতায় আসার পর তিনি পালিয়ে চলে আসেন আমেরিকায়।
জেফ বেজোসের জীবনী থেকে জানা যায়, ছোট্ট বয়স থেকেই জেফের আগ্রহ দেখা যায় বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তিন বছর বয়সেই তিনি স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে তার খেলনা খুলে ফেলতে শিখেছিলেন।
অনাগত সময়কে দেখতেন
জেফ বেজোস যখন হাইস্কুলে পড়েন তখন তার গ্রাজুয়েশন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তিনি এমন এক অনাগত সময়কে দেখতে পাচ্ছেন যখন মানুষ মহাশূন্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করবে।
জেফ বেজোস ইঞ্জিনিয়ারিং আর কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়েন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর নিউইয়র্কে গিয়ে চাকরি করেন কয়েকটি ফিনান্স কোম্পানিতে। তার স্ত্রী ম্যাকেঞ্জির সাথে এসময়ই পরিচয় হয় তার।

২০১৬ সালে স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি স্কট ও তাদের চার সন্তানের সাথে ‘স্টার ট্রেক বিয়ন্ড’ ফিল্ম প্রিমিয়ারে ধনকুবের জেফ বেজোস, ছবি: ওয়াল ট্রিট জার্নাল
বেজোসের বয়স যখন ৩০, তখন একটা পরিসংখ্যান চোখে পড়ে তার, যাতে বলা হয়েছিল ইন্টারনেটের দ্রুত বৃদ্ধির কথা। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, চাকরি নয়, নিজেই কিছু একটা করবেন।
বেজোস চলে গেলেন আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তের শহর সিয়াটলে। তার নিজের জমানো কিছু টাকা, আর পরিবারের কিছু সাহায্য, সব মিলিয়ে এক লাখ ডলারের কিছু বেশি অর্থ— এই ছিল তার বিনিয়োগ।
এক মাসের মধ্যেই ব্যবসা প্রসার
তিনি ১৯৯৫ অ্যামাজন নামে একটা কোম্পানি চালু করলেন, অনলাইনে পুরোনো বই বিক্রির। এক মাসের মধ্যে অ্যামাজন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সবগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ৪৫টি দেশে অর্ডার পাঠালো। পাঁচ বছর পর অ্যামাজনের ক্রেতার একাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়ালো ১ কোটি ৭০ লাখে।
শুরুতে বিক্রি ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ডলার, আর পাঁচ বছর পর তা দাঁড়ালো ১৬০ কোটি ডলারে। বড় বড় কোম্পানি আমাজনের দরজায় ছুটে আসতে শুরু করলো।
৩৫ হওয়ার আগেই ধনকুবেরদের একজন
১৯৯৭ সালে অ্যামাজন পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হলো, আর অর্থ উঠলো ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বয়স ৩৫ হবার আগেই বেজোস হয়ে গেলেন পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের একজন।

১৯৯৪ সালে একটি অনলাইন বইয়ের দোকান দিয়ে অ্যামাজানের যাত্রা শুরু করেছিলেন জেফ বেজোস, ছবি: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং
১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে আখ্যা দিলো ‘কিং অব সাইবার-কমার্স’ আর মনোনীত করলো পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়স্ক ‘পিপল অব দি ইয়ারের’ একজন হিসেবে।
আমাজনের ব্যবসার কৌশল
জেফ বেজোসের কৌশল ছিল, তিনি অর্থ আয় করার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হননি। অ্যামাজনে পণ্য বিক্রির জন্য তিনি ফ্রি শিপিং সুবিধা দিয়েছেন, দাম কম রেখেছেন। কিন্ডল ই-বুক রিডারের মতো যন্ত্র তৈরির জন্য বছরের পর বছর সময় ব্যয় করেছেন।
অন্যদিকে আবার অ্যামাজন যেখানে যেভাবে সম্ভব টাকা বাঁচিয়েছে। অ্যামাজনের হেড অফিসে কর্মীদের গাড়ি পার্ক করার জন্য পয়সা দিতে হয়েছে। সরবরাহকারীদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে, তারা ওয়্যারহাউজে শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে গেছে এবং যেখানে যতটা সম্ভব ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে।
এ বছর জুন মাসে অ্যামাজন পণ্য বিক্রি করেছে ৫৩০ কোটি ডলারের। প্রথম তিন মাসে মুনাফা করেছে ২৫০ কোটি ডলার। অ্যামাজনে চাকরি করেন ৫ লাখ ৭৫ হাজার লোক, যা ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গের জনসংখ্যার প্রায় সমান।
আমাজনে যারা পণ্য বিক্রি করেন তাদের জন্য পণ্য আনা-নেওয়া, ঋণ, বিক্রির প্ল্যাটফর্ম দেওয়া, পাশাপাশি এর ‘ক্লাউড কম্পিউটিং বিভাগ’ অনেক বড় বড় কোম্পানির জন্য অনলাইন ডেটা স্টোরেজ সুবিধা দিচ্ছে, যা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম।
২০১৭ সালে তারা খাদ্যপণ্যের কোম্পানি গোল ফুডস কিনে নেয়, অনলাইন ফার্মেসি কিনে নেয়। আরও নানা রকম চুক্তির আলোচনা চলছে। এক কথায়, অ্যামাজনের নতুন নতুন উদ্যোগ হাতে নেওয়ার উৎসাহ এতটুকু কমেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকারও মালিক জেফ বেজোস।
অন্য অনেক ধনীর মতোই বেজোসের শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব নেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার সমালোচকদের একজন। এদের মোকাবিলায় লবিস্ট নিয়োগের পেছনে খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে অ্যামাজন।