২০১৬ সালে ভুটান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়েছিল ঢাকায়। আমার এক বন্ধু ‘দ্য রেড ডোর’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি সেখানে দেখে, যা তাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। তাই পরদিন ফেস্টিভ্যালে আমাকে ওর সাথে সিনেমাটি দেখতে বাধ্য করে। অতঃপর বন্ধুর এমন স্নেহময় আবদার রক্ষা করি। সিনেমাটি দেখা শেষ হলে দুজনেই চুপ করে থাকি।
মজার কথা হলো আমরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই সিনেমাটি নিয়ে পরে আর আলোচনা করিনি। আমাদের যদি বলতে বলা হয় দেখে কি মনে হলো, আমরা হয়তো গুছিয়ে বলতেও পারব না। অথচ সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রটির দৈর্ঘ্য ৫ মিনিটও হবে না। সংলাপ নেই তেমন, কিন্তু অসামান্য দৃশ্যগল্প দিয়ে দর্শককে থমকে দেয়!
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটির পরিচালক ভুটানের তাশি গেলটশেন। তার চিন্তায় গৌতম বুদ্ধের দর্শনের ছাপ স্পষ্ট। এর গল্পটা একটু বলার চেষ্টা করি। ঘরের ফুটো চাল থেকে টপ টপ পানি পড়ার আওয়াজে জেগে যান সিনেমার একমাত্র চরিত্র। সাধারণ দেখতে মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ। পরনে ভুটানের ট্রাডিশনাল ঘরোয়া পোশাক। ভীষণ নিরানন্দময় অন্ধকার একটা আবহাওয়া তার ঘরে। এরই মাঝে তার ফোনে একটা কল আসে। এত নির্জনের মাঝে আসা সেই ফোনকলটা কেন জানি তার একাকিত্বকে আরও প্রবল করে তুলল।
এখান থেকে শুরু হলো লাল দরজা কাঁধে চরিত্রের লম্বা এক যাত্রা। সে যাত্রার গন্তব্য কোথায় বা কি তার উদ্দেশ্য আমরা জানি না। কেবল দেখা যাচ্ছে, এই লাল দরজা নিয়ে সে হেঁটে চলেছে। সবুজ ঘাস লতা-পাতার মাঝ দিয়ে… হাতছানি দিয়ে ডাকা ফসলের ক্ষেতের মাঝ দিয়ে… বিশাল বিশাল গাছের গোলকধাঁধার মাঝ দিয়ে… সেই লাল দরজা কাঁধে নিয়ে সে কেবল হেঁটেই চলেছে। এরপরে সে একটা সেতু পার হলো, ঠিক যেন জীবনের শেষ অধ্যায়টা রচিত হতে চলেছে এবার। এই পর্যায়ে তাকে আরও কষ্ট করে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়। অবশেষে সে চলে আসে এক শব্দহীন প্রান্তরে, প্রাণহীন পাথরের খণ্ডের মাঝে।
মনোমুগ্ধকর সবুজ থেকে মন খারাপ করা প্রাণহীন বাদামী রঙের মাঝে এসে শেষ পর্যন্ত সে পাহাড় চূড়ায় উঠতে সমর্থ হয়। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে কাঁধ থেকে দরজাটা নামিয়ে সেটা খুলে ভিতরে ঢুকে! কিসের ভিতরে ঢুকে পড়লো— এই প্রশ্নটা আসার সুযোগ নেই। কারণ পর্দায় আমরা যা দেখছি তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে এই লাল দরজা আসলে একটা প্রতীক। কিসের প্রতীক সেটার বোঝাপড়া চলছে পরিচালক ও দর্শকের মাঝে।
সেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে তিনি কারও উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মা, আমি বাড়ি এসেছি।’ এরপরে তিনি মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ব্যাস, চলচ্চিত্রের ঘটনা এতটুকুই।
মৃত্যুও কি এমনই এক দরজার মতো নয়? একটা দরজা থেকে অন্য দরজা পর্যন্ত আমাদের এই যাত্রা। শেষ সংলাপে এসে পৌঁছানোর জানান দেওয়ার মধ্য দিয়ে নবজন্মের ইঙ্গিত করা হলো। বুদ্ধের দর্শন অনুযায়ী আমরা জানি, এই মায়ার জগতমাত্রই জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আঁটকে থাকা। তাই আমরা এক জীবন থেকে আরেক জীবনে ঘুরতে থাকি। বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে আমাদের কোনো অস্তিত্ব নাই। পুনর্জন্ম যদি থেকে থাকে তবে মৃত্যুই জন্মের উৎস। অন্যভাবে বললে, কোনো মৃত্যুই নেই এখানে। তবে স্থূলভাবে কেবল জীবন-মরণ আকারে বুদ্ধের এই দর্শনকে দেখলে মূল থেকে দূরে থাকা হবে। মানুষের চিন্তার জগতে পুনর্জন্মের যে বাঁধন সেটিও উল্লেখ করা দরকার। পরিচালক তাশি বলেন, ‘যে মৃত্যুকে আমরা প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াই, আমি তাকে একটু বিশ্রাম দিতে চেয়েছি।’

রটারডামে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্রে উৎসবে দর্শকদের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বে পরিচালক তাশি গেলটশেন
পরিচালক তাশির ২২ বছর বয়সী ভাগ্নে এবং ভুটানের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কাছাকাছি সময়ে আত্মহত্যা করেন। ব্যাপারটি পরিচালকসহ ভুটানবাসীকে মর্মাহত করেছিল। তাশি বলেন, তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে তখন এই সিনেমাটি নির্মাণ করেন। এটাই তার কান্নার একমাত্র উপায়। জীবন আর মৃত্যু হলো এই সিনেমার মুখ্য চরিত্র। তাশির মতে, ‘লাল’ রঙটা বিপদ, নৈরাশ্য ও মৃত্যু বুঝিয়ে থাকে। একইভাবে এটি মায়ের জরায়ু অর্থাৎ নতুন-জীবন, নিরাপত্তা আর উষ্ণতাকেও বোঝায়। চলচ্চিত্রে তাই এই লাল দরজা কাঁধে করে একজন মানুষের একা যাত্রার গল্পটিকে বোনা হয়েছে। সে একাই তার ভাগ্য বয়ে বেড়াচ্ছে। যখন সে দরজা খুলে বাড়ি এসেছে বলে জানায়, তখন আসলে সে আরেক জন্মে প্রবেশ করলো। এই দরজাটা এখানে তাই জন্ম-মৃত্যুর মেটাফোর হিসেবে কাজ করছে যা প্রতিটি অস্তিত্বের দুটো চরম সত্য।
স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাটির মাঝে একটা পেইন্টিং-কোয়ালিটি মূর্তমান হয়ে রয়েছে। একটার পর একটা প্রতীকী ল্যান্ডস্কেপের মাঝ দিয়ে গতিশীল সহজ বুননটা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। শেষ দৃশ্যে যখন একটা খোলা জায়গায় দরজাটাকে রাখা হলো, তখন মনে হয় বদ্ধতা আর উন্মুক্ততা ঠিক এই বিন্দুতে এসে যেন মিলিয়ে গেলো। আর এটিকেই সে বাড়িতে ফিরে আসা বলছে!
বুকের মাঝখানে কেমন হু হু করে ওঠে… …