বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য সৌন্দর্যের অংশ হাওর। বিশেষ করে স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটম্বুর সুনামগঞ্জের হাওর-বাঁওড়। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, পাখির কলতান আর করচ-হিজল বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে। নদী, বিল, পুকুর ও হাওরের স্বচ্ছ পানির বুকে শুভ্র শাপলার পাগল করা হাসি প্রেয়সীর হৃদয়কাড়া হাসির মতোই মনে হয়।
শিশিরভেজা শিউলি ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে হাসে। এমন প্রকৃতি অনুভব করতে ভ্রমণপিয়াসী মন ছুটে বেড়াতে ইচ্ছা করে চারদিক। আর তাই এই শরতে ছুটে গিয়েছিলাম হাওরের রূপ উপভোগ করতে। যান্ত্রিক জীবনের ধকল কাটাতে অন্যদের মতো অনেকটা হুট করেই প্ল্যান করি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসার। ঠিক হলো, আমাদের গন্তব্য হবে টাঙ্গুয়ার হাওর। পাশাপাশি দেখব ছবির মতো সুন্দর নীলাদ্রি লেক, সীমান্তঘেঁষা লাকমাছড়া ঝরনা, শিমুলবাগান, বারিক্কা টিলা ও জাদুকাটা নদী। সঙ্গে সাক্ষাৎ মিলবে দূরের মেঘালয়ের পাহাড়ের।

হিজল-করচের বন নোঙ্গর করা হাউস বোট, ছবি: জলছবি
ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে তাহিরপুর ঘাটে পৌঁছে হাউসবোটে উঠে পড়লাম। হাউসবোটটি পুরো এক দিন আমাদের ট্যাকেরঘাট ঘোরাবে। তাহিরপুর বাজারে মোট দুটি ঘাট রয়েছে।
সকালের খাওয়া সেরেই বোটে উঠে পড়লাম হাওরের সৌন্দর্য দেখতে। হাউসবোট যতই হাওরের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি ধরা দিচ্ছে। থেকে থেকে চোখে পড়ছে চরে বেশ কিছু জনবসতি। মূলত এই এলাকার মানুষ বর্ষা মৌসুমে হাওরের মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। পানি কমে গেলে জেগে ওঠা জমিতে রবিশস্য ও বোরো ধান, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খামার করে।
সাদা বকের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে পৌঁছি দুপুরের দিকে। অন্যান্য অংশের তুলনায় পানি স্বচ্ছ বিধায় এখানে সব ট্রলারই একটা বিরতি দেয় গোসল ও খাবারের জন্য। সামান্য উপার্জনের তাগিদে শিশুরা ডিঙি নৌকা নিয়ে ভিড় জমায় ট্রলারগুলোর কাছে। ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দিয়ে হিজলবাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। বেড়ানোর সময় জায়গাটার সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া যায় রাতারগুলের। তবে শুকনো মৌসুমে হাওরে জল কম থাকলে হেঁটেই পার হওয়া যায়।

হাউস বোটে হাওড় বিলাস, ছবি: জলতরঙ্গ
হাউসবোট যতই এগিয়ে যাচ্ছে, হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড়ের রূপ ততই উঁকি দিচ্ছে। তবে বৃষ্টি থাকায় দূরের পাহাড়গুলো অনেকটাই ঝাপসা লাগল এদিন। ট্যাকেরঘাট যখন পৌঁছি তখন বিকেল ৪টা ছুঁইছুঁই। প্রচণ্ড ক্ষুধায় দিশেহারা সবাই। হাউসবোটের ছাদে বসে হাওরের মাছ আর হাঁসের মাংস খেলাম তৃপ্তি নিয়ে। খানিক বিশ্রাম শেষে দল বেঁধে বের হলাম লেকের সৌন্দর্য দেখতে। লেকটি আসলে চুনাপাথরের খনি ছিল একসময়। শহীদ সিরাজ লেক হিসেবে কাগজে-কলমে নাম থাকলেও পর্যটকদের কাছে এটি নীলাদ্রি লেক হিসেবেই সমাদৃত। ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট গভীর স্বচ্ছ পানির আধার এটি। সীমান্তঘেঁষা মেঘালয়ের পাহাড় আর লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম বিকেলজুড়ে। লেকের ধারে পরিত্যক্ত ক্রেন আর ভাঙা রেলকোচ আজও খনির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
রাতে বর্ডারের উঁচু পাহাড়ে সোডিয়ামের হলদে আলো এলাকাজুড়ে এক মায়াময় দৃশ্যের জন্ম দেয়। ট্যাকেরঘাটের দোকানপাট রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত খোলা। খাবার শেষে ভরা পূর্ণিমায় হাওরের বুকে ট্রলার নোঙর করে গল্প-আড্ডা দিয়েই রাতটা পার করি আমরা। হাওরের চারপাশ জুড়ে থাকা মানুষের জীবনযাত্রা আর প্রকৃতি আনমনা করে দেয় নিজেকে। হঠাৎ বলে উঠে মন জীবনানন্দের সুরে-
আমি যদি হতাম বনহংস/ বনহংসী হতে যদি তুমি / কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে / ধানক্ষেতের কাছে / ছিপছিপে শরের ভিতর / এক নিরালা নীড়ে;

লাইফ জ্যাকেট পরে হাওড়ে জলকেলি, ছবি: জলতরঙ্গ
হাওরে হাউসবোট
টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম আকর্ষণ হলো নৌকায় থাকার দিনগুলো। এই অভিজ্ঞতাটিই টাঙ্গুয়ার হাওরের ট্যুরকে আলাদা করে অন্য সব ট্যুর থেকে। বৃষ্টির সময়ে নৌকায় বসে চায়ের চুমুকে দূর মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর দৃশ্য যেন জাগিয়ে তুলে যে কারও ভেতরের কবিকে। একসময় মনে করা হতো এই হাওরে হয়তো শুধু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেই ঘুরতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে থাকার জন্য আধুনিক ও আরামদায়ক নৌকা প্রচলিত হওয়ায় এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অনায়াসে এই হাওর ঘুরে আসা সম্ভব।
হাউসবোটে জনপ্রতি পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার ৫০০ টাকা (এক কেবিনে দুজন) ভাড়া পড়বে এক রাত দুই দিনের খাবারসহ।
কীভাবে যাবেন
টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার জন্য প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে সরাসরি সুনামগঞ্জে যাওয়া যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেট হয়ে সেখান থেকেও সহজেই সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর যেতে হবে লেগুনা কিংবা অটোরিকশায়। এ ছাড়া এ পথে মোটরবাইকেও যাত্রী পরিবহন করা হয়৷ তাহেরপুর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন রকম হাউসবোট ভাড়ায় পাওয়া যায়।