রিসাদ, বয়স মাত্র দুই। চোখে তার মায়া আর মুখে এক টুকরো চাঁদের মতো নিষ্পাপ হাসি। কিন্তু তার হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক কঠিন লড়াই। সেরিব্রাল পালসির সঙ্গে জীবনযুদ্ধ।
রিসাদের মা ফারহানা আফরোজ জানালেন, জন্মের পর রিসাদ কাঁদেনি। জন্মের সময় চিকিৎসকরা জানিয়েছিল রিসাদ ব্রেনে অক্সিজেন কম পেয়েছে। কিন্তু তখন এত কিছু বুঝিনি। ধীরে ধীরে খেয়াল করলাম রিসাদ ঘাড় শক্ত করতে পারছে না, হামাগুড়িও দেয় না। ডাকলেও ফিরে তাকায় না। তখনই বুঝলাম কিছু একটা ঠিক নেই।
সেরিব্রাল পালসি কী, কেনো হয়, সেরিব্রাল পালসির চিকিৎসা এবং পরিবারের সচেতনতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন থেরাপিউটিক সল্যুশন বাংলাদেশ এর ফিজিওথেরাপিস্ট মাইনুল ইসলাম সোহাগ।
কী এই সেরিব্রাল পালসি?
সেরিব্রাল পালসি সম্পর্কে মাইনুল ইসলাম সোহাগ বলেন, এটি কোনো একক রোগ নয়। সেরিব্রাল পালসি একধরনের মস্তিষ্কজনিত স্থায়ী সমস্যা। যা শিশুর চলাফেরা, দেহের ভারসাম্য, নড়াচড়া, কথা বলা এবং শেখার দক্ষতায় প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে প্রায় ৩.৪ জন শিশু সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়।
তিনি জানান, শিশুর জন্মের আগে, জন্মের সময় বা পরবর্তী সময়ের নানা জটিলতা থেকেই এই সমস্যার শুরু হতে পারে। যেমন জন্মের সময় অক্সিজেনের অভাব, গর্ভকালীন ইনফেকশন (যেমন রুবেলা বা সাইটোমেগালোভাইরাস), অপরিণত বা কম ওজন নিয়ে জন্মানো। এমনকি অতিরিক্ত জন্ডিস থেকেও সেরিব্রাল পালসি হতে পারে।
শিশু যদি বয়স অনুযায়ী কিছু সাধারণ কাজ না করে যেমন ঘাড় শক্ত করা, বসা, হাঁটা, মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসা, ডাকলে সাড়া দেওয়া। এছাড়াও অস্বাভাবিক কাঁপুনি, হাত-মুষ্টিবদ্ধ থাকা, পেশি অস্বাভাবিক শক্ত বা দুর্বল দেখা যায় তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
রিসাদের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। নির্ধারিত বয়স পার হয়ে গেলেও সে বসতে পারছিল না। মায়ের চোখে চোখ রেখে সে হাসতো না। শুরু হলো বিভিন্ন ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষানিরীক্ষা। অবশেষে এক নিউরোপেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ রিসাদের সেরিব্রাল পালসি নিশ্চিত করেন।
লড়াইয়ের শুরু, হাল না ছাড়ার গল্প
সেরিব্রাল পালসির চিকিৎসা শুধু ওষুধ নয়, নিয়মিত থেরাপিই পারে শিশুর উন্নয়ন ঘটাতে। যেমন- ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি। রিসাদের জন্য তৈরি হলো বিশেষ চলাচল ডিভাইস। বাড়ির পরিবেশকেও থেরাপি উপযোগী করে গড়ে তোলা হলো। সবচেয়ে বড় কথা, মা-বাবা হার মানেননি।
রিসাদের মা ফারহানা বলেন, প্রতিদিন রিসাদের হাত ধরে বসার অনুশীলন করতাম। খেলনার আওয়াজ করে তার প্রতিক্রিয়া দেখতাম। প্রথমবার ও যখন নিজের হাতে খেলনা ধরল, চোখে পানি এসেছিল।
সেরিব্রাল পালসির চিকিৎসা বহুজন সমন্বিত উদ্যোগ এমনটাই জানালেন এই ফিজিওথেরাপিস্ট। শিশু নিউরোলজিস্ট থেকে শুরু করে ফিজিওথেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, মনোবিদ, পুষ্টিবিদ ও সমাজকর্মী সবাইকে মিলে একটি শিশুর উন্নয়নে কাজ করতে হয়।
সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে শিশুর বুদ্ধিমত্তা, কথা বলার ক্ষমতা, এমনকি ঘুম বা খাওয়ার ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার মাংসপেশির অস্বাভাবিক শক্ততা হাড়ের গঠন বদলে দেয়। অনেক সময় অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয় তাই অনেক সময় অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞেরও প্রয়োজন হয়।
বর্তমানে শিশুদের সেরিব্রাল পালসির মত জটিলতা শনাক্ত করে থেরাপি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে স্টেম সেল থেরাপির মতো আধুনিক চিকিৎসাও চালু হয়েছে।
মাইনুল ইসলাম সোহাগ বলেন, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপ, সঠিক পুষ্টি, ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা, নিরাপদ প্রসব, অপরিণত শিশুর বিশেষ যত্ন এবং জন্মের পরপরই নবজাতকের প্রতি যত্নশীল পরীক্ষা এই সবই সেরিব্রাল পালসি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।
আজ রিসাদ স্বাভাবিক শিশুদের মতো নয় ঠিকই, কিন্তু সে হাসে, চোখে চোখ রাখে, নিজের মতো করে শব্দ করে কথা বলার চেষ্টা করে। তার মা জানেন রিসাদ পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না হয়তো, কিন্তু যতদূর সম্ভব তাকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলবেন।
সেরিব্রাল পালসি মানেই শেষ নয়। সঠিক সময়ে সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপই হতে পারে একটি শিশুর নতুন সম্ভাবনার সূচনা।
আপনার শিশুর বিকাশে যদি কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেন, দেরি না করে নিকটস্থ শিশু বিকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। কারণ শিশুর বিকাশ মানেই জাতির বিকাশ।