প্রতিবছর বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস সেইসব ডানাওয়ালা যাত্রীদের জন্য উদযাপিত হয় যারা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। মে ও অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শনিবার পালিত এই দিবসটির লক্ষ্য শুধুই উদযাপন নয়, বরং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাসস্থানের ক্ষয়, শিকার ও দূষণ—এই সব চ্যালেঞ্জের মুখে পরিযায়ী পাখিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে আমরা শুধু পাখিদের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করি না, বরং তাদের যাত্রাপথ, বিপদ এবং সংরক্ষণের গুরুত্ব নিয়েও ভাবি। একজন পাখি গবেষকের চোখে এই দিনটির তাৎপর্য আরও গভীর। কারণ প্রতি পরিযানেই লুকিয়ে থাকে আবহাওয়া পরিবর্তনের ইঙ্গিত, বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও মানব হস্তক্ষেপের চিহ্ন। বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস উপলক্ষ্যে হ্যালো বাংলাদেশ-এর সাথে একান্ত আলাপে পাখিপ্রেমী ও বন্যপ্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপু জানিয়েছেন পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাসনিম তাবাসসুম।

বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে আমরা শুধু পাখিদের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করি না, বরং তাদের যাত্রাপথ, বিপদ এবং সংরক্ষণের গুরুত্ব নিয়েও ভাবি, ছবি: ফেসবুক
পাখির প্রতি ভালোবাসার শুরুটা কীভাবে হলো?
খুব ছোটবেলা থেকেই যে পাখির প্রতি প্রেম আছে তা নয়। আমার বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে, পদ্মা-মেঘনা নদীর তীরে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে বহুবার। পদ্মার চর যমুনার চর খুবই পছন্দের জায়গা। এখানে শীতকালে ঘটে হরেক রকম পাখির সমাগম। কিন্তু এসব জায়গায় বেড়াতে গেলে দেখা যেত কেউ পাখি শিকার করছে, কেউ করছে হত্যা। এসব দৃশ্য যখন মনকে ব্যথিত করে তখন মনে হয়, এবার অবাধে পাখি নিধন নিয়ে কিছু একটা করা দরকার। ভ্রমনের প্রতি ভালোবাসাই পরবর্তীতে পাখির প্রতি প্রেমের জন্ম দেয়।
১৯৯৯ সালের দিকে ঢাকায় আসি। এরপর বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য হই। সারাদেশে পাখি বিষয়ক ক্যাম্পেইন, পাখি মেলা, স্কুলে বাচ্চাদের পাখির কথা বলা, আর পাখি শুমারিতে যোগ দেয়া এসব কাজ করি ২০০৩ সালের দিকে। জাতীয় পাখি শুমারিতে বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছি, দিয়ে যাচ্ছি। এভাবে যখন থেকে পাখিকে আক্ষরিক অর্থেই দেখা আর বোঝা শুরু করি, তখন থেকেই পাখির প্রতি প্রেমের শুরু।

রেমা -কালেঙ্গা ভালচার সেফ জোন, ছবি: ফেসবুক
বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি নিয়ে আপনার গবেষণার কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পর্কে জানতে চাই।
শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো এশিয়ার পাখি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে আমার, বিশেষ করে পরিযায়ী পাখি নিয়ে। আমার একটি মাইলস্টোন কাজ বলা যায় শকুন (vulture) পাখিদের জন্য। বাংলাদেশে শকুনদের জন্য দুইটি রেস্কিউ সেন্টার আছে। প্রতি বছর ৪০-৫০ টি শকুনকে এখানে আশ্রয় দেয়া হয়। তাদের খাবার, চিকিৎসা, পরিচর্যার পর এপ্রিল মাসে এদের বনে ছেড়ে দেয়া হয়। শকুনের সংখ্যা অনেক কমে যওয়ায় ভালচার ফিডিং স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। রেস্কিউ সেন্টারে প্রতি রবিবার একটা গরু দেয়া হয়। প্রতি বছর শকুনরা যে বাচ্চা দেয় সেগুলোর যত্নআত্তিও হয় সেখানে।
পাখিদের স্যাটেলাইট ট্যাগিং শুরু হয় ২০১৯ সালে। মাইগ্রেটরি হাঁস পাখি ও সৈকত পাখিদের প্রথম স্যাটেলাইট ট্যাগিংয়ের কাজ আমার হাত ধরে শুরু। কোন কোন দেশ থেকে কীভাবে ও কোন পথে পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে আসে, এসব তথ্য পাওয়া যায় পাখিদেরকে স্যাটেলাইট ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে। পৃথিবীর ৭টি দেশ থেকে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি আসে। কোন কোন জায়গায় পাখি বেশী দেখা যায়, কোথায় কম, কোথায় পাখিদের সাথে মানুষের মেলামেশা বেশি, কোথায় পাখি হত্যার হার বেশি– সবই জানা যায় স্যাটেলাইট ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে।
শিকারী পাখি পালাস’স ফিশ ঈগল মঙ্গোলিয়া থেকে প্রতি শীতে বাংলাদেশে আসে টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ বিভিন্ন হাওড় অঞ্চল গুলোতে। বর্তমানে গবেষণার মাধ্যমে এরা কোন কোন অঞ্চলে পরিযান করে, এদের জীবনচক্র জন্ম -মৃত্যুহার নিয়ে গবেষণা চলমান। মঙ্গোলিয়াতে ৪ এবং বাংলাদেশে ৯ ধরনের পাখি স্যাটেলাইট ট্যাগিং করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে মঙ্গোলিয়া যেতে এদের প্রয়োজন হয় ২৮-৩০ দিন।
বাংলাদেশে ২০টি অঞ্চল জুড়ে প্রতিবছর পাখিশুমারি হয়। বাংলাদেশে প্রথম বার্ড রিংগিং শুরু হয় ২০১০ সালে। এটি পাখির ওপর প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। শিকারী পাখির জন্য কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান, ওয়েট ল্যান্ড বার্ডের জন্য স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ডেভেলপসহ অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কাজের নেতৃত্ব দিয়েছি।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) থেকে ৫৭০টি পাখির রেড লিস্টিং করা হয়েছে। কোন পাখি বিলুপ্ত হয়েছে, যা আছে তাদের অবস্থা কেমন, মহাবিপন্ন পাখি, বিপন্ন পাখি কোনগুলো এগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়েছে , যাতে কোন পাখি সংরক্ষণ করতে কেমন পদক্ষেপ নিতে হবে তা বোঝা যায়। এরকম অসংখ্য কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণেই।

টাঙ্গুয়ার হাওরে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, ছবি: ফেসবুক
আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ বর্তমানে কেমন?
প্রায় ৩০ প্রজাতির হাঁস পাখি মূলত হাওড় অঞ্চলে আসে শীতকালে। এদের সংখ্যা ২ লাখের মতো। উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও পদ্মা যমুনার পারেও দেখা মেলে পরিযায়ী পাখির। উপকূলীয় অঞ্চল ও সোনাদিয়া দ্বীপে জলচর ১০০ প্রজাতির সৈকত পাখি আসে। যার সংখ্যা প্রায় অর্ধলাখের মতো।
আমাদের দেশে ৪-৫ লাখের মতো বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। বিভিন্ন ছোটছোট বিলে লোকাল মাইগ্রেন্ট পাখির আনাগোনা দেখা যায়। এরা এক বিল থেকে অন্য বিলে বিচরণ করে। প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর পরিযায়ী হাঁসগুলো আমাদের দেশে ৬-৭ মাস থাকে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিযায়ী পাখিদের কতটা আদর্শ?
বাংলাদেশ দুইটা ফ্লাইওয়ের মাঝে পরে। ইস্ট এশিয়ান – অস্ট্রেলেশিয়ান ফ্লাইওয়ে , সেন্ট্রাল এশিয়ান ফ্লাইওয়ে। শীতকালে তিব্বত, চায়না, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে আমাদের দেশে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে। এই সময়ে ঐসব অঞ্চল বরফে ঢেকে যায়। তখন পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশের সমতল ভূমিতে নেমে আসে।
এদেশের শীতকালের আবহাওয়া পরিযায়ী পাখিদের জন্য খুবই উপযোগী। আমাদের দেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া জীব বৈচিত্র্যের জন্য ‘হটস্পট’, এই অঞ্চলে শীতকালে ঘাস হয়, বর্ষাকালে পানি নেমে গেলে পানিতে পাওয়া যায় শামুক- ঝিনুক, ছোট ছোট মাছ যা পরিযায়ী পাখিদের জন্যে উপাদেয় খাবার।
বাংলাদেশে কোন কোন স্থান পরিযায়ী পাখিদের জন্য জনপ্রিয়?
টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিলে সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী হাঁস পাখি দেখা যায়। সৈকত পাখি দেখা যায় উপকূলীয় এলাকায়। সোনাদিয়া দ্বীপ নিঝুম দ্বীপের দমার চর, সোনার চরসহ ৩০টির বেশি ছোট ছোট চরে সৈকত পাখি বেশি আসে। ছোট ছোট ঘাস পাখি (warbler) বর্ষার পর পানি নেমে গেলে আমাদের হাওড় অঞ্চলের ঘাসবন গুলোতে আসে।

পালাস’স ফিশ ঈগল (Pallas’s Fish-Eagle), ছবি: আইনেচারলিস্ট
বছরে সাধারণত কত ধরণের অভিবাসী পাখি এদেশে আসে?
আমাদের প্রায় ৩২০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আছে। গ্রীষ্মকালে পিট্টা বা শুমচা প্রজাতির পাখি ও কোকিলের কিছু প্রজাতি পরিযায়ী হয়ে আমাদের দেশে আসে। কিন্তু শীতকালে এর সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায়। শীতকালে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি এই দেশে আসে।
চোরা শিকার, অযাচিত উৎপাত, বৈরি পরিবেশের কারণে পাখিরা নিধনের শিকার হয়, তারপরও প্রতি বছর এদেশে কেন অভিবাসী পাখি আসে?
প্রান্তিক অঞ্চলে পাখি শিকার একটা বড় সমস্যা। আগে রীতিমতো আয়োজন করে পাখি শিকার করা হতো, গুলি করে পাখি হত্যা করা হতো। সরকার এয়ার গান ব্যবহার করে পাখি হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখন পাখি নিধনে ব্যবহার করা হয় উন্নত প্রযুক্তি। বিষটোপ ব্যবহার করে বা ফাঁদ পেতে পাখি নিধন করে অনেকেই।
এটা আসলে মানুষের সচেতনতার অভাব। কিন্তু এত পাখি যাবে কোথায়? যদিও তাদের সংখ্যা প্রতিবছর কমে যাচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের ৫৯% পাখি কমে গেছে। ১৯৯২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সবচেয়ে কম পাখি এসেছে এই বছর। মাত্র ২২,৬০০। যা ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণত লাখের মত থাকে। হাকালুকি হাওরের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। চাষের হাঁস হাওরে পালন করা পরিযায়ী পাখির আগমনের জন্য হুমকি স্বরূপ। এটি পাখি শিকারের থেকেও বড় সমস্যা। নদীর পারে ঘাসবনগুলোর গো-চারণ ভূমিতে রূপান্তর- এগুলো আপাতদৃষ্টিতে কিছু মনে না হলেও পরিযায়ী পাখিদের জন্য বড় একটি সমস্যা।
পরিযায়ী পাখির নিরাপত্তা দানে কী ধরনের আইন আছে?
পরিযায়ী পাখি শিকার, হত্যা, বেচা-কেনা এমনকি তাদের যেকোন ক্ষতি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে শুধু আইন না মানুষের মধ্যে পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে সচেতনতা তৈরি করার প্রয়োজন অনেক বেশি। যেমন- শিকারকে পেশা হিসাবে নিষিদ্ধ করা, পাখি কেনাবেচা ও খাওয়া বন্ধ করা, পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থলে গো-চারণ ভূমি ও দেশি হাঁস চাষ করে তাদের খাদ্যের সংকট তৈরি না করা। অর্থাৎ যার যার নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিলেই অতিথি পাখি নির্ভয়ে আমাদের দেশে বিচরণ করবে।
আমাদের দেশের আবহাওয়া পাখির জন্য স্বর্গ। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া পাখি সংরক্ষণে বড় অবদান রাখছে। কোথাও কেউ পাখি শিকার করতে গেলে, তাদের বাসস্থান নষ্ট করলে এখন সচেতন মানুষ তা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি তুলে বা ভিডিও করে আপলোড করে দেয়। এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে।

পায়ে রিং পড়ানোর পর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে রঙিন নর্দার্ন শভেলার হাঁস, ছবি: ফেসবুক
পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে আমাদের করণীয় কী?
তরুণ প্রজন্ম পাখি-বিষয়ক গবেষণা সম্পর্কে খুবই কম জানে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাখি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত করতে হবে। শুধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নয়, এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও খুবই জরুরি। বর্তমানে দেখা যায় হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠান পাখি নিয়ে কাজ করছে। সরকারি উদ্যোগে বৃহত্তর পরিসরে পাখি নিয়ে গবেষণার ব্যবস্থা করতে হবে।
স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি-বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে পাখি বিষয়ক গবেষণামূলক তথ্যগুলোর সংযোজন প্রয়োজন। আমাদের পাঠ্যবইয়ে গৎবাঁধা ভাবে লেখা থাকে শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখি আমাদের দেশে আসে। কিন্তু আমার নিজের গবেষণায় দেখেছি, একটি পরিযায়ী পাখিও সাইবেরিয়া থেকে বাংলাদেশে যাওয়া আসা করে না। তাদের ভ্রমণপথ তিব্বত, চীন ও মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়া (মঙ্গোলিয়া সংলগ্ন অঞ্চল) থেকে বাংলাদেশের দিকে।
পরিযায়ী পাখি কোনো একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বাসিন্দা নয়। এরা এক অঞ্চলে ডিম পাড়ে তো অন্য অঞ্চলে যায় খাদ্যের সন্ধানে। যেসকল দেশজুড়ে এদের বিচরণ এরকম আমরা সব দেশ মিলে তাদের সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিতে পারি।
বাংলাদেশে ৫৩২ প্রজাতির পাখি আছে। কিন্তু গোটা ইউরোপে মাত্র ২০০ প্রজাতির পাখি আছে। এত বৈচিত্র্যময় পাখির সমারোহ আমাদের দেশে থাকলেও এগুলো নিয়ে গবেষণামূলক কাজের সংখ্যা কম। গাছ লাগানোর জন্য যেমন প্রতি বছর ক্যাম্পেইনিং করা হয়, তেমনি পাখি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করা যায়।
২০০০ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর বার্ড ফেয়ার বা পাখি মেলার আয়োজন করা হয়। বছরে আমরা ৫-১০ টি পাখিমেলার আয়োজন করি। যদি এইসব আয়োজন আরও তৃণমূল পর্যায়ে করা যায় তাহলে সবার পাখির প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা বাড়বে।

পরিযায়ী পাখিরা তিব্বত, চীন, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার (মঙ্গোলিয়া সংলগ্ন অঞ্চল) থেকে বাংলাদেশে আসে, ছবি: ফেসবুক
আমরা শিশুদের মধ্যে কীভাবে পাখিপ্রেম গড়ে তুলতে পারি?
বাচ্চাকে শুধু পাখি পর্যবেক্ষণ করার প্রতি আগ্রহী করলেও তা পাখিপ্রেম জাগ্রত করার পিছনে একটি বড় পদক্ষেপ হবে। বাচ্চাদের প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন করলে, প্রকৃতিকে ভালোবাসলে গ্যাজেটের প্রতি আসক্তি যেমন দূর হয়, তেমনি প্রকৃতি নিয়ে তাদের জানার আগ্রহ বাড়ে।
পাখিকে খাঁচায় না রেখে তাদেরকে ভালোবাসা শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকে শিখতে হবে। আমার বারান্দায় ‘বার্ড ফিডার’ রাখা আছে যেখানে পাখিদের জন্য দানাদার খাবার দেয়া হয়। এতে ধীরে ধীরে বারান্দায় অনেক পাখি আশা শুরু করেছে, বিশেষ করে মুনিয়া পাখি। তারা দানা-পানি খেয়ে চলে যায় , আবার খেতে আসে। এভাবে আমার বাচ্চাদের পাখির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে।
বাচ্চাদের স্কুলগুলোতে পাখি মেলার আয়োজন করা অনেক কার্যকরী। আমি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের জেনালের সেক্রেটারি। কেউ যদি নিজ প্রতিষ্ঠানে পাখি মেলার আয়োজন করতে চায় তাহলে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সাথে যোগাযোগ করলে এ ব্যাপারে তারা সাহায্য করবে। সেখানে পাখি দেখা, পাখি চেনা ইত্যাদি প্রতিযোগিতা, বার্ড রেস (পাখি পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা) ও এক্সিবিশনের আয়োজন হয়।
বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে আমাদের বার্তা কী হওয়া উচিত?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগ আগে আমি কয়েকজনের সাথে মিলে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি দিবস উদযাপন শুরু করি। এটা খুবই ভালো লাগার একটা বিষয় যে বর্তমানে এই দিবস বড় পরিসরে জাতীয় পর্যায়ে উদযাপিত হয়। পরিযায়ী পাখিদের অতিথি পাখি ভাবা যাবে না। এগুলো আমাদেরই পাখি, এদের সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আমাদের।
পরিযায়ী পাখি এদেশে না আসলে এর প্রভাবে আমাদের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে। পরিবেশ, অর্থনীতি এমনকি আমাদের জীবনেও এর প্রভাব পড়বে। এদের রক্ষা করা যে যার অবস্থান থেকে সবারই কর্তব্য। আমি আশা করি, পরিযায়ী দিবস যেন সবার সচেতন অংশগ্রহণের মাধ্যমে পালন করা হয়। এভাবেই পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারব।
সীমান্ত দীপুর জন্ম ১০ জানুয়ারি, ১৯৮৩ নওগাঁ জেলার সদর থানার চকরাজবল্লভ গ্রামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন্যপ্রাণী বিষয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি এখন প্রায় জলে-জঙ্গলের মানুষ। বন্যপ্রাণীর সব শাখায় তাঁর বিচরণ থাকলেও পাখি গবেষণায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। বন্যপ্রাণী বিষয়ের ওপর লেখকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র দেশি-বিদেশি জার্নালে ছাপা হয়েছে।বর্তমানে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারে (আইইউসিএন) বন্যপ্রাণী গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন।