সিরিয়ায় ২৪ বছর ধরে শাসন করা স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে গত ৮ ডিসেম্বর উৎখাত করে রাজধানী দামেস্ক দখল করে নেয় আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। আসাদ মুক্ত হওয়ার পর সিরীয়রা যখন উদযাপনে ব্যস্ত তখন গোলান মালভূমিসহ দক্ষিণ সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ দখল করতে শুরু করেছে প্রতিবেশি ইসরায়েলি সেনা। একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে নেতানিয়াহুর বাহিনী।
আসাদের বিদায়ের সাথে সাথে সিরিয়া-ইসরায়েল সীমান্তের ‘বাফার জোন’ অধিগ্রহণের পর হারমন পর্বতের অংশের দখল নিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। তাদের দাবি, আসাদ সরকারের পতন হওয়ার পর অস্ত্র ও সামরিক স্থাপনাগুলো যাতে বিদ্রোহীদের হাতে চলে না যায় ও ইসরায়েলের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে, এ জন্য তারা অভিযান চালাচ্ছে। এরপর অগ্রসর হতে থাকে দামেস্কের দিকে।
নতুন ইতিহাস
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যদিয়ে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে ইসরায়েল। এরপর ১৯৭৪ সালে সিরিয়া-ইসরায়েলের মধ্যে একটি নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিষ্ঠার চুক্তি করা হয়। এই চুক্তির পর গত ৫০ বছরে সীমিত অভিযান ছাড়া এই রেখা অতিক্রম করেনি তেলআবিব।
কিন্তু ৮ ডিসেম্বর আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দাবি করেন, সিরিয়ার সঙ্গে ১৯৭৪ সালের চুক্তির আর কার্যকারিতা নেই। তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদের সমর্থন নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে মিলে আমি আইডিএফকে বাফার জোন এবং এর কাছাকাছি প্রভাবশালী জায়গাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। আমরা কোনো শত্রুকে আমাদের সীমান্তের কাছে আসতে দেব না।

বিপর্যস্ত সিরিয়ার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ হারমন পর্বতের নিয়ন্ত্রণ নিলো ইসরায়েলি বাহিনী, ছবি: সিএনএন
তার এই ঘোষণার পর বাফার জোনের সিরিয়া অংশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আইডিএফ। একইদিনে বাফার জোন থেকে অগ্রসর হয়ে সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে অবস্থিত হারমন পর্বতের দখলও নিয়ে নেয় তারা। বাফার জোনের পর প্রথমেই হারমন পর্বতের দখল নিয়েছে আইডিএফ।
আগ্রাসী অভিযানের নিন্দা
ইসরায়েলের এমন আগ্রাসী অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক কিংমেকার সৌদি আরব, কাতার ও ইরাক। এরপর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নেতানিয়াহুকে সিরিয়ায় হামলা বন্ধ করতে আহ্বান জানান। কিন্তু সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে দামেস্কে হামলা অব্যাহত রাখে আইডিএফ।
কেন এতো তড়িঘড়ি
হারমন এই সীমান্ত অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু স্থান হওয়ায় এটি সামরিক অবস্থানের দিক থেকে কৌশলগত সুবিধা নিয়ে আসে। যে কারণে বাফার জোনের পর প্রথমেই হারমন পর্বতের দখল নেয় আইডিএফ।
আসাদ সরকারের পতনের পর বিদ্রোহীদের হাত থেকে সিরিয়ার সামরিক সম্পদকে দূরে রাখতে চেয়েছিল দখলদার ইসরায়েল। এ জন্য সিরিয়ার প্রায় ৫০০ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা, নৌবাহিনী ঘাঁটি ধ্বংস এবং সিরিয়ার বেশকিছু এলাকা দখল করার জন্য বোমা ফেলতে কালক্ষেপণ করতে বিলম্ব করেনি তারা। তবে সিরিয়ার সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট হারমনের দখল ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অর্জন বলে প্রতীয়মান হতে পারে।
হারমনের কৌশলগত গুরুত্ব
মাউন্ট হারমনস সামিট ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বিশাল সম্পদ। ৯ হাজার ২৩২ ফুট উঁচু চূড়াটি সিরিয়া বা ইসরায়েলের যেকোনও পর্বত থেকে উচ্চতর এবং লেবাননে শুধুমাত্র একটি চূড়ার মধ্যে দ্বিতীয়। সম্প্রতি হারমত পর্বতটি নিরস্ত্রীকরণ করা হয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা এটির টহল দিচ্ছিলেন। এটি বিশ্বে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ স্থায়ী অবস্থান ছিল।

১৯৭৪ সালে সিরিয়ার হারমন পর্বতে কামানসহ ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি, ছবি: সিএনএন
বাফার জোন বা নিরাপদ অঞ্চল দখলের পর সিরিয়ার অংশে থাকা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হারমন পর্বতেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। হারমন পর্বত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু জায়গা, যার উচ্চতা ২ হাজার ৮শ ১৪ মিটার। হারমন পর্বতকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক দুর্গ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এখান থেকে শত্রুদের আক্রমণ সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব।
এছাড়া এখান থেকে রাজধানী দামেস্কের দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। হারমন পর্বতে রাডার স্থাপনের মাধ্যমে এখন অনেক বিস্তৃত এলাকা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে ইসরায়েল। উপরে অবস্থানের কারণে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি নজরদারিতে বিশেষ সুবিধা পাবে তারা।
ইসরায়েলের হুঁশিয়ারি
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরা কাটজ সেনাবাহিনীকে শীতকালীন কঠোর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, সিরিয়ার পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তার জন্য মাউন্ট হারমনের চূড়ার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ার গোলান মালভূমির বাফার জোনে ইসরায়েলি সাঁজোয়া যান, ছবি: সিএনএন
বিশ্লেষকদের অভিমত
জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটি (জেআইএসএস)-এর পরিচালক এফ্রাইম ইনবার বলেছেন, লেবানন, সিরিয়া, ইসরায়েলের দিকে তাকালে এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে উচুঁ স্থান। এটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ের কোনো বিকল্প নেই।
এফ্রাইম ইনবার আরও বলেন, মানুষ মাঝে মাঝে বলে ক্ষেপণাস্ত্রের যুগে জমি গুরুত্বপূর্ণ নয়- এটি ডাহা মিথ্যা। এখান থেকে সিরিয়ার ভূখণ্ডের গভীরে ইলেকট্রনিক নজরদারি ব্যবহার করা যাবে। পরবর্তীতে যেকোনো আক্রমণের ক্ষেত্রে ইসরায়েল আগাম সতর্কবার্তা পাবে।
সমরবিদরা বলছেন, উন্নত সেন্সর স্থাপনের ফলে শত্রুর যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হবে। সঙ্গে সেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যাবে। বিশেষ বাহিনী সিরিয়া ও তার বাইরে গোপন অভিযান পরিচালনার জন্য পাহাড়ের আবরণকে কাজে লাগাতে পারে।
সিএনএন অবলম্বনে