Home সর্বশেষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ও প্রতিরোধে করণীয়

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ও প্রতিরোধে করণীয়

তাওহীদ মাহমুদ
১২৯ views

‘নীরব ঘাতক’ ডায়াবেটিস বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী গুরুতর এক স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে পরিচিত। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। বাংলাদেশের ১০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় এই ডায়াবেটিসে। প্রতিরোধযোগ্য এই রোগটি নিয়ে হ্যালো বাংলাদেশ-এর মুখোমুখি হয়েছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিয়া আফসানা। ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং কীভাবে জীবনধারা পরিবর্তন করে এই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারি— এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাওহীদ মাহমুদ।

হ্যালো বাংলাদেশ: ডায়াবেটিস আসলে কী?
ডা. ফারিয়া: সাধারণভাবে বলতে চাই, ডায়াবেটিস অর্থ হচ্ছে রক্তে গ্লুকোজ স্বাভাবিকের চাইতে বৃদ্ধি পাওয়া। শরীরে ইনসুলিন হরমোনের অভাব বা এর কার্যকারিতার অভাবে রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রায় না থাকাকে আমরা ডায়াবেটিস বলে থাকি।

হ্যালো বাংলাদেশ: ডায়াবেটিস কত হলে স্বাভাবিক বলা চলে?
ডা. ফারিয়া: আমরা ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে খালি পেটে এবং খাবার খাওয়ার দুই ঘন্টা পর ব্লাড সুগার মাপতে বলি। অনেকেই মনে করেন, শুধু খালি পেটে এবং নাস্তা খাওয়ার ২ ঘণ্টার মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ। আসলে তা নয়। দুপুরে খাবারের ২ ঘণ্টা পর এবং রাতে খাওয়া দুই ঘণ্টা পর ডায়বেটিস মাপা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আমরা খালি পেটে ৬ অথবা ৬ এর নিচে এবং খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ৮ থেকে ১০ এর মধ্যে থাকলে স্বাভাবিক ধরতে পারি। তবে সেটা বয়স ভেদে ভিন্ন, তরুণদের জন্য একটু স্ট্রিক্ট। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমরা বলি, যেসব বাচ্চার ডায়াবেটিস আছে তাদের রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা আরেকটু রিলাক্স রাখতে বলি এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা তিন মাসের গড়ে ৭ এর নিচে থাকলে ভালো।

হ্যালো বাংলাদেশ: কোন বয়সের মানুষ সবচেয়ে বেশি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকে?
ডা. ফারিয়া: এক কথায় বলতে গেলে কোনো বয়সই ডায়াবেটিসের ঝুঁকির বাইরে না। আজকাল সব বয়সের মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। একটা সময় মনে করা হতো, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি ছোট কিংবা বড়— সব বয়সের মানুষেরই ডায়াবেটিস হতে পারে। এ জন্য দরকার সচেতনতা এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা।

হ্যালো বাংলাদেশ: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ে কি টিপস দিবেন?
ডা. ফারিয়া: গর্ভকালীন ডায়বেটিস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন গর্ভবতী নারীকে আমরা দুইভাবে দেখি। একটা হতে পারে, একজন নারীর আগে থেকেই ডায়াবেটিস ছিল, এখন সে প্রেগনেন্সিতে কিভাবে সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখবে সে চেষ্টা করা। দ্বিতীয় হচ্ছে, কখনোই তার ডায়াবেটিস ছিল না কিন্তু প্রেগনেন্সি অবস্থায় তার ডায়াবেটিস হয়েছে, যাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই খুব ভালো টার্গেট অ্যাচিভ করতে হবে। খাদ্য ব্যবস্থার দিকে ভালোভাবে নজর রাখতে হবে। প্রেগনেন্সিতে যদি কোনো জটিলতা না থাকে তাহলে তিনি ফিজিক্যাল মুভমেন্ট ও এক্সারসাইজ করবেন। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে।

চিকিৎসার কথা যদি বলি, প্রেগনেন্সির সময়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা হলো, প্রয়োজন মাফিক ইনসুলিন নেওয়া, গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্তের গ্লুকোজ মেপে সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু পার্থক্য থাকবে খালি পেটে সাড়ে পাঁচ এবং খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ৬.৭ এর মধ্যে রাখতে হবে। তবে যাদের ডায়াবেটিস কখনো ছিল না, গর্ভকালীন অবস্থায় হয়েছে, তাদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানো উচিত। কেননা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে ভবিষ্যতে মা ও বাচ্চা দুজনেরই ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

সেক্ষেত্রে যে নারীর ডায়াবেটিস ছিল না অবশ্যই তার গর্ভধারণের পূর্বে ডায়াবেটিস ক্লিনিং করে নেওয়া উচিত। যদি ওভার ওয়েট থাকে তা কমিয়ে নেওয়া উচিত। ডায়াবেটিসের অন্য ঝুঁকিগুলো হ্রাস করে প্রেগনেন্সি প্ল্যান করলে ডায়াবেটিস অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

হ্যালো বাংলাদেশ: কোনো লক্ষণ ছাড়া কি ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে?
ডা. ফারিয়া: সাধারণত কিছু লক্ষণ দেখে আমরা ডায়াবেটিস বুঝতে পারি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো লক্ষণ ছাড়াই কেউ হঠাৎ করে ব্লাড সুগারের মাত্রা মাপতে গিয়ে দেখেন যে রক্তে সুগারের মাত্রা বেশি আছে। আবার অনেকে অন্যান্য পরীক্ষার সাথে রক্তের গ্লুকোজ টেস্ট করলে দেখা যায় ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। সেটাকে আমরা টাইপ-২ ডায়াবেটিস বলি। শতকরা ৯৫ ভাগই টাইপ-২ডায়াবেটিস। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ মানুষই জানে না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে। যেহেতু তাদের কোনো লক্ষণ নাই। সুতরাং লক্ষণ ছাড়াও ডায়াবেটিস হতে পারে।

এছাড়া ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নিয়েও একজন রোগী আসতে পারেন। তার আগে থেকে জানা ছিল না যে ডায়াবেটিস আছে। কিন্তু তার কিডনির সমস্যা দেখা দিয়েছে, চোখে নানান জটিলতা, পায়ে একটা ক্ষত দেখা দিয়েছে। তখন উনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে তার ডায়াবেটিস আছে। এমন অনেক রোগী আমরা পেয়ে থাকি। সুতরাং কোনো লক্ষণ ছাড়াও ডায়াবেটিস হতে পারে।

হ্যালো বাংলাদেশ: সুগার কেন হয় বা সুগার কমিয়ে আনার উপায় আছে কিনা?
ডা. ফারিয়া: অবশ্যই ডায়াবেটিস কম থাকার জন্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে— এটাই আমাদের টার্গেট। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ার কারণ হলো, রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কমে যাওয়া। সুতরাং এই দুইটা জিনিস এডজাস্ট করেই নতুন চিকিৎসা সেবা চালু হচ্ছে। আমরা এই নতুন চিকিৎসা প্রয়োগ করে অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখতে পারি।

হ্যালো বাংলাদেশ: ডায়াবেটিস পুরোপুরি নির্মূল হওয়া সম্ভব কি?
ডা. ফারিয়া: ডায়াবেটিস চিরতরে নির্মূল হয় কিনা— এই প্রশ্ন অনেক রোগী করে থাকেন। ব্যাপারটা যদি একটু অন্যভাবে বলি, তাদেরকে আশ্বস্ত করি এভাবে, ডায়াবেটিস হওয়া মানে ভীতির কিছু না। ডায়াবেটিস নিয়েও আমরা ভালো থাকতে পারি।

ডায়াবেটিস ধরা পড়ার আগে রোগীর খাদ্যে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার কারণে তার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয় এবং ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি (শারীরিক পরিশ্রম) করতে হয়। সেক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ছাড়াও অন্যান্য রোগের জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সুতরাং ডায়াবেটিস নিয়ে ভয় না, সুস্থ থাকাটাই আমাদের প্রধান টার্গেট।

হ্যালো বাংলাদেশ: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ বা কমানোর ঘরোয়া কোনো উপায় আছে কী?
ডা. ফারিয়া: ঘরোয়া উপায় বলতে বিষয়টিকে যদি আমি অন্যভাবে বলি যে, ঘরে বসেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ— এটাই এখন আমাদের টার্গেট। একজন রোগী যেন নিজে নিজেই তার ডায়াবেটিসের মাত্রা নিজে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে— এটাই আমাদের টার্গেট। সে জন্য অবশ্যই একজন রোগীর পর্যাপ্ত চিকিৎসা শিক্ষা থাকা প্রয়োজন। কিভাবে তিনি গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা মাপবেন এবং রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ অনুযায়ী কিভাবে মেডিসিন অথবা ইনসুলিন এডজাস্ট করে ভালো থাকবেন। এই জিনিসগুলো যখন একজন রোগীকে শিখিয়ে দিতে পারি তখন তিনি ক্লোজ ফলোআপে না এসেও ভালো থাকতে পারবেন।

হ্যালো বাংলাদেশ: ডায়াবেটিস প্রতিরোধে আপনারা কী ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
ডা. ফারিয়া: ডায়াবেটিস প্রতিরোধ নিয়ে আমাদের ডায়াবেটিস সমিতিতে চিকিৎসা লেভেলে অনেক কাজ চলছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন স্কুল কমিউনিটিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কোনো এলাকায় এমন লোকদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে যাদের কথা মানুষ শোনে। যেমন, মসজিদের ইমাম যদি খুতবার সময় ডায়াবেটিস এবং এর প্রতিরোধ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেন, তাদের কথা এলাকায় সাধারণ মানুষ শুনবে। এমন কথা চিন্তা করেই বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, যেটা শুনে সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। তা ছাড়া চিকিৎসক, নার্স এবং প্যারামেডিকেল ডাক্তাদের মধ্যেও এসব ট্রেনিং চলছে।

হ্যালো বাংলাদেশ: কী করলে এই রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব?
ডা. ফারিয়া: প্রতিরোধের কথা যদি বলি, যারা উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন তাদের জন্যই প্রতিরোধটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিসের ঝুঁকিগুলো কমিয়ে ফেলুন, যেগুলো কমানো সম্ভব। যেমন- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখ, ফিজিক্যাল একটিভিটি করা, বা নিয়মিত ব্যয়ামের অভ্যাস গড়ে তোলা, ফাস্টফুড না খাওয়া, ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। এই বিষয়গুলোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস অনেকাংশে কমিয়ে রাখা সম্ভব।

আরও যা পড়তে পারেন

কমেন্ট করুণ