সৃষ্টির এক অপার বিস্ময় সমুদ্র। সমুদ্রের জলরাশি ও এর নিচে লুকিয়ে থাকা রহস্য যতই সামনে আসছে ততই চমকে উঠছে মানুষ। সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশের এক রহস্য সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। মাটির ওপরে যেমন মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তা আছে, ঠিক তেমনই আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপের উত্তরে সমুদ্রের ৩ হাজার মিটার গভীরে হলুদ রঙের একটি রাস্তার খোঁজ পেয়েছেন গবেষকরা। কে তৈরি করল এই রাস্তা? কীভাবেই বা তৈরি হলো এই রাস্তা?
অনেকে মনে করছেন, এটা সমুদ্রের নিচে হারিয়ে যাওয়া রহস্যময় শহর আটলান্টিসের রাস্তা। ইটের এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আটলান্টিসে যাওয়া যাবে। সমুদ্রের নিচে হারিয়ে যাওয়া এই শহর নিয়ে এতদিন মানুষের মধ্যে যে কল্পনা ছিল সেটাই কি তাহলে বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে?— এমন আলোচনা শুরু হয়েছে নেট দুনিয়ায়।
গ্রিক পৌরাণিক অনুযায়ী, আটলান্টিস সমুদ্রের তলায় হারিয়ে যাওয়া একটি দ্বীপ। প্রথম এই সভ্যতার উল্লেখ পাওয়া যায় প্লেটোর ‘টাইমাউস অ্যান্ড ক্রিটিয়াস’ বইয়ে। প্লেটোর লেখা অনুযায়ী, প্রায় ৯ হাজার বছর আগে আটলান্টিস সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। হারকিউলিসের পিলারের পাদদেশের এই দ্বীপ নৌবাহিনী দিয়ে ইউরোপের অধিকাংশ স্থান জয় করে। কিন্তু এথেন্স জয় করার পরে এক প্রলয়ের মুখোমুখি হয়ে চিরতরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায় আটলান্টিস সভ্যতা।
প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় ইট বাঁধানো রাস্তা, ছবি: আইএফএল সায়েন্স
তবে এই সভ্যতার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্লেটোর সমসাময়িক অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। অনেকে আবার আটলান্টিসকে কল্পনাপ্রসূত বলেও উড়িয়ে দিয়েছেন। আটলান্টিসের সত্যতা নিয়ে বিদ্রুপও করেছেন কেউ কেউ। তবে অনেকেই আটলান্টিসের উপস্থিতিকে সত্যি বলে মেনে নিয়ে সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে থাকা ধনরত্নের খোঁজে অভিযানও চালিয়েছেন। কিন্তু সাগরের তলায় লুকিয়ে থাকা এই দ্বীপের খোঁজ পেতে সবাই ব্যর্থ হয়েছে।
রঙ হলুদ হওয়ার কারণ
গবেষকদের একাংশের দাবি, সমুদ্রের নিচে পাওয়া এই রাস্তার উপস্থিতি যথেষ্ট অদ্ভুত হলেও অনেক সময় আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বের হয়ে আসে। সেই লাভা জমেই এই রাস্তা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ধাতু রয়েছে, তাই এর রঙ হলুদ হয়েছে। গবেষকদের আরেক অংশের দাবি, অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বারবার গরম ও ঠান্ডা হওয়ার কারণে পাথরের গায়ে ফাটল তৈরি করেছে। আর তাতেই এই অভিনব নকশা তৈরি হয়েছে।
যেভাবে সন্ধান পাওয়া গেল
‘এক্সপ্লোরেশন ভেসেল নটিলাস’ নামের একটি জাহাজ নিয়ে একদল গবেষক প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার পাপাহানাউমোকুয়াকে মেরিন ন্যাশনাল মনুমেন্ট- পিএমএনএম’র লিলিউওকালানি রিজ নামক সামুদ্রিক অঞ্চলে গবেষণা চালায়। ওই সময় এই রাস্তার খোঁজ পান তারা। রাস্তার কাঠামো ভেঙেচুরে গেলেও খাঁজ কাটা নকশা দেখে বিজ্ঞানীদের ধারণা কোনো এক সময় রাস্তাটি ব্যবহারযোগ্য ছিল।
আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপের পাপাহানাউমোকুয়াকে অনুসন্ধান করছেন গবেষকরা, ছবি: সায়েন্স এলার্ট
উল্লেখ্য, পিএমএনএম হলো বিশ্বের বৃহত্তম সামুদ্রিক সংরক্ষিত বা মেরিন কনজারভেশন অঞ্চলগুলোর একটি। এটি আমেরিকার সব জাতীয় উদ্যানের সম্মিলিত আয়তনের চেয়েও বড়। এ পর্যন্ত এই সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চলটির মাত্র ৩ শতাংশ তলদেশেই অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়েছে।
ওশান এক্সপ্লোরেশন ট্রাস্টের গবেষকরা প্রতিনিয়ত এই সংরক্ষিত অঞ্চলটির সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর রয়েছে সেখানে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি সমুদ্রের ৩ হাজার মিটারেরও বেশি গভীরে অবস্থিত।
অনুসন্ধানী অভিযান দেখার সুযোগ
যে কেউ চাইলেই গবেষকদের এই অভিযান দেখার সুযোগ পাবেন। অনুসন্ধানী অভিযানের ধারণকৃত কিছু দৃশ্যের একটি ভিডিও সম্প্রতি ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, গভীর সমুদ্রে অভিযান পরিচালনার সময় গবেষকরা আটলান্টিসে যাওয়ার পথে হলুদ ইট বিছানো একটি রাস্তার সন্ধান পেয়েছেন। অন্তত দেখতে তেমনটাই মনে হয়েছে। একজন গবেষককে তাই বলতে শোনা যায়, ‘এটি আটলান্টিসের রাস্তা।’ আরেকজন বলে ওঠেন, ‘হলুদ ইটের রাস্তা?’
সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিস সভ্যতার উল্লেখ পাওয়া যায় প্লেটোর টাইমাউস অ্যান্ড ক্রিটিয়াস বইয়ে, ছবি:সায়েন্স এলার্ট
মজার বিষয় হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠে নুটকা পর্বতের চূড়ায় গবেষকদের খুঁজে পাওয়া লেকের তলদেশটি আশ্চর্যজনকভাবে শুকনো দেখায়। ‘হলুদ ইটের রাস্তা’র মতো এই তলদেশকে গবেষকরা ‘বেকড ক্রাস্ট’-এর মতো দেখায় বলে অভিহিত করেছেন, অনেকটা যেন খোসা ছাড়ানোর মতো এর স্তরগুলো খুলে খুলে আসবে।
চোখের এক চমৎকার বিভ্রম
আসলে এটি হলুদ ইটের তৈরি কোনো রাস্তা নয়। সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির একটি শিলা এমনভাবে ভেঙেছে যে, এটিকে ইট বিছানো রাস্তা বলে মনে করছেন কোনো কোনো গবেষণক। বলা যেতে পারে, চোখে চমৎকার এক বিভ্রম তৈরি করেছে দৃশ্যটি।
প্রথম দেখায় সমুদ্রের তলদেশে ইট-নির্মিত এমন একটি অনন্য রাস্তা নতুন এক বিস্ময়কর পৃথিবীর সন্ধান দেবে বলে বিভ্রান্তি হতেই পারে। কিন্তু একটু অন্যভাবে চিন্তা করলে বিষয়টিকে পুরোপুরি মিথ্যা বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা ইটের মতো এই রাস্তা অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে গবেষকরা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। অচিরেই পৃথিবীর লুকানো ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যাবে।
তথ্যসূত্র: সায়েন্স এলার্ট ও জি নিউজ
